|| রিয়াজ হায়দার চৌধুরী ||
একুশের প্রথম কবিতার কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর জীবন সঙ্গী, বাংলাদেশের উন্নয়ন আন্দোলনে নারীর ক্ষমতায়নে প্রথমভাগের সফল উদ্যোক্তা,
চট্টগ্রামের কৃতীকন্যা জওশন আরা রহমানও(৮৯) চলে গেলেন !
তাঁর বিদায়জনিত শূন্যতা কি আর পূরণ হবে !
কবি পত্নীর এই মৃত্যু আমাকে মুহূর্তেই স্মৃতির ভেলায় নিয়ে গেল।
বাংলাদেশের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নারী উন্নয়ন এবং পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শিশু উন্নয়ন সংযোজনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
দুপুর একটার পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে এই মহীয়সীর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ( ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহির রাজিউন) খবরটি দিলেন কবির ভাতিজা এম কে আনোয়ার চৌধুরী।
প্রায় একমাস ধরে টানা শয্যাশায়ী চিকিৎসাধীন ছিলেন এই উন্নয়ন সংগঠক। প্রচার বিমুখ ছিলেন এই নারী। ‘স্মৃতিকথা : একটি অজানা মেয়ে’ দৈনিক সংবাদে নিয়মিত লিখতেন। এই ধারাবাহিক এর গ্রন্থাকারে প্রকাশ অনুষ্ঠান হয়েছিল শেরাটন হোটেলে। মোড়ক উন্মোচন করেছিলেন প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান।
ঢাকায় স্হায়ী আবাস গড়া এই চট্টলকন্যার দাফন হবে আজ বাদ মাগরিব বনানী কবরস্থানে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর পাশেই।
কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর কবরে শেষ মাটিটুকু দিয়ে এসেছিলাম আমি। সেদিন বৃষ্টিস্নাত ছিল।
রাতে কবির মৃত্যুর খবর পেয়ে বাসযোগে উত্তরা তিন নম্বর সেক্টরে কবির বাসভূমে ভোরে পৌঁছেছিলাম। অতঃপর মর্চুয়ারি থেকে লাশ নিয়ে শহীদ মিনার হয়ে জানাজা শেষে দাফন অবদি কবির কবরের পাশে ছিলাম আমি।
তখন এই সময়ের মতো জমকালো মুঠোফোনের আলোকসজ্জা বা প্রদর্শনবাদিতা ছিল না।
তখন আমি চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন-সিইউজে’র প্রথম দফায় নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। চট্টগ্রাম থেকে এক তরুণ হিসেবে ছুটে গিয়েছিলাম ‘সীমান্ত’ সম্পাদক কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। সাথে ছিলেন কবির নাতি ও সংগঠক মহসীন চৌধুরী। যাবার আগে সাংবাদিক খোরশেদুল আলম শামীমের দুবাই থেকে আনা ক্যামেরা সংগ্রহ করেছিলাম মহসীন চৌধুরীর পরামর্শে। তাঁরা রাউজানের কৃতি সন্তান এই বরেণ্য কবির শেষ যাত্রার ছবি ধরে রাখতে দায়িত্বশীল ছিলেন। সেই সময়ে ফেরার পথে ক্যামেরার রিচার্জেবল ব্যাটরি যে কোথায় ফেলে এসেছি, তাও আর মনে করতে পারিনি।
একুশের প্রথম কবিতার কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর লাশ শহীদ মিনার থেকে বনানী কবরস্থান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পথে ট্রাকেই কবির লাশের পালেই ছিলাম মহসীন চৌধুরী, এমন কে আনোয়ার সহ আমরা।
আজ কবি পত্নীর বিয়োগে সেদিনের সেইসব কথাও মনে পড়ছে খুব। মনটা যে কেমন লাগছে বুঝাতে পারবো না।
কবি শামসুর রহমানের ভাষায় যদি বলি, তো বলতে হয়, ‘ বনপোড়া হরিণীর মত আর্তনাদ করছে হৃদয়’ ।
কবি পত্নী জওশনা আরা রহমান আমাকে খুব স্নেহ করতেন। কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সব কটি বই ঢাকা থেকে পাঠিয়েছিলেন আমাকে । এর মধ্যে তিনি চট্টগ্রামে এলে একবার এম কে আনোয়ার চৌধুরীর বাসায় উঠেছেন। তখন আমি গিয়ে দেখা করে এসেছিলাম।
তরুণ নেতা মাহবুব উল আলম চৌধুরী যখন ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ লেখেন, সেই ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি, সেই অগ্নিমুখর সময়ে থেকেই জওশন আরা রহমান তাঁর জীবন সঙ্গী। চট্টগ্রামের আয়েশি সন্তান কবির জীবনটাকে যেন একটি সূচিবন্ধ ধারায় পরিচালিত করার ক্ষেত্রে মূল মানুষটি ছিলেন তিনি। কবির ২৭ টি গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা ছিল তাঁর পত্নীরই।
জীবনসঙ্গীর ভূমিকা একজন পুরুষকে কতটুকু এগিয়ে দেয়, সেটির এই মহীয়সী নারীই বড় উদাহরণ।
কেউ কেউ বলতেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী সেই একটি কবিতা লিখেই হারিয়ে গিয়েছিলেন, পরবর্তীতে তিনি ছিলেন ম্রিয়মাণ !
চট্টগ্রাম কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক, মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখা নাট্যজন, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদও একসময় এমন মন্তব্য করেছেন। কিন্তু মাহবুব উল আলম চৌধুরী ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিলেন । ৯০ দশক থেকে আবার তাঁর নতুন গতিধারা শুরু। এর আগে অনেকটা লোক চক্ষুর আড়ালেই চলে যাওয়া এই কবি জাতীয় পর্যায়ে পরবর্তীতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন । চট্টগ্রাম থেকে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কেন্দ্রীয় সভাপতি হয়েছিলেন তিনি একজনই।
জীবন সায়াহ্নেও তাঁর লেখা ছিল ক্ষূরধার। তিনি শুধু কবিতা লেখেননি গদ্যও অসাধারণ ছিল তাঁর ।
তিনি লিখে গেছেন,
‘ আমি যদি চলে যাই, বন্ধ করোনা লড়াই ‘ , যা আমি প্রকাশ করি আমার সম্পাদিত ‘বঙ্গজ’ এ ২০০৬ সালেই। কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন বঙ্গজ এর উপদেষ্টা পরিষদেরও সদস্য ।
জওশন আরা রহমান ও কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী এক কন্যা সন্তান সহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। সফল এই দম্পতি জাতীয় পর্যায়েও ছিলেন অনেকের নির্ভরতার ঠিকানা।
কবিপত্নীর জীবন ছিল নানামুখী অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ । বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে উন্নয়ন পদক্ষেপে তিনি অগ্রবর্তী। ইউনিসেফের জন্য জীবনের সুবর্ণ সময়টুকু দিয়ে গেছেন। নারীকে উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে এই মহীয়সীর অবদান অনস্বীকার্য। ইউনিসেফের নারী উন্নয়ন কর্মসূচি প্রধান ছিলেন । এছাড়াও প্রোগ্রাম প্ল্যানিং সেকশনের প্রধানও ছিলেন ।
বহুমাত্রিক এই লেখক ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম শহরের সমাজ কল্যাণ অফিসার হিসেবে সরকারি চাকরিতেও যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে ‘ডেপুটি ডিরেক্টর’ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ‘গ্রামীণ সমাজ কল্যাণ মাদার্স ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেন। পেশাগত কারণে তিনি ইউরোপ আমেরিকা ও এশিয়ার প্রায় ৩০ টি দেশ ভ্রমণ করেন।
চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের ছাত্র সংসদের সদস্য ছিলেন। ১৯৫৫-৫৬ সালে ‘অন্বেষা’ নামে একটি বার্ষিক ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতেন। ১৯৫৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রী সংসদের চট্টগ্রাম জেলা শাখার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
১৯৩৬ সালের ১৯ অক্টোবর দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার চুনতি গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুন্সেফ পরিবারে জন্ম এই কীর্তিমতির। চট্টগ্রাম শহরের খ্যাতনামা ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগের মেট্রিক পাস করেন ১৯৫২ সালে। মেট্রিক পাস করার আগেই তিনি সেই সময়ের ছাত্র সংগ্রাম কমিটির নেতা ও তরুণ কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তৎকালীন ‘ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার’ থেকে এমএ পাস করেন। ১৯৯৬ সালে ইউনিসেফ থেকে অবসর নিয়েও তিনি থেমে থাকেননি । দুবার স্কলারশিপ নিয়ে তিনি নিউজিল্যান্ডে যান। ওয়াশিংটনে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে সোশ্যাল সায়েন্সে পোস্ট গ্রেজুয়েট ডিগ্রী লাভ করেন।
বহু গুণে গুণান্বিত এই নারী উদ্যোক্তা সংগঠক সমাজকর্মী ও লেখকের প্রয়াণে তাঁর জীবনের সুবর্ণ সময়টুকু ও মানুষের জন্য অকাতরে রেখে যাওয়া নানা অবদান স্মরণ করে গভীর শ্রদ্ধা জানাই ।
মরহুমার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। শোকাহত পরিবারের সদস্যদের প্রতিও জানাই গভীর সমবেদনা।
সিএনবিন/এলসি