এখনো মিথ্যা ও গায়েবি মামলার খড়গ ঝুলছে বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মাথার ওপর। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রয়েছে ৩৭টি মামলা। রাষ্ট্রপতির নির্দেশে কারামুক্তি মিললেও মামলা প্রত্যাহার বা শেষ হয়নি একটিও। অন্যদিকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রয়েছে ৮০টি মামলা।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যেভাবে ছিল সেভাবেই রয়েছে সব মিথ্যা মামলা। দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল- ৫ আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের পর বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ নেতা-কর্মীরা সব মিথ্যা মামলা থেকে মুক্তি পাবেন। এক মাসের মধ্যেই দলের সব নেতা-কর্মীর সর্বস্তরের মিথ্যা ও গায়েবি মামলা প্রত্যাহার করা হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় আড়াই মাস হলেও এখনো পর্যন্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলের কোনো নেতা-কর্মীর একটি মামলাও প্রত্যাহারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
সারা দেশে ৬০ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে (প্রায়) ৪ লাখ মামলার খড়গ পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের মতোই স্থির হয়ে আছে। এতে ভীষণ ক্ষুব্ধ সারা দেশের বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন এ প্রসঙ্গে গতকাল বলেন, ‘মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি। এ নিয়ে আমরা আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দসহ সিনিয়র আইনজীবীরা কয়েক দফা বৈঠক করেছি।
কীভাবে কী প্রক্রিয়ায় এ মিথ্যা ও গায়েবি মামলাগুলো দ্রুত শেষ করা যায় তার কৌশল নিয়ে আলোচনা করেছি। প্রতিটি মামলাই দায়ের করা হয়েছে প্রচ- রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত। এগুলো সবই সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট মামলা। কোথাও কোনো ঘটনা ঘটেনি, অথচ দেওয়া হয়েছে নাশকতার মামলা। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছে দুর্নীতির মামলা।
অথচ এসবের সঙ্গে তাঁর বিন্দুমাত্র কোনো সম্পর্ক নেই। আর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য মিথ্যা মামলা। অথচ তিনি দেশে নেই আজ এক যুগেরও বেশি সময়। খুব শিগগিরই আমরা (সিনিয়র আইনজীবীরা) আবারও বসব এবং এ নিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ের আলোচনা করব। আশা করি খুব শিগগিরই মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়াটা আমরা শুরু করতে পারব ইনশা- আল্লাহ। ’
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক এবং বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল গতকাল বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মামলাগুলো পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের আমলে যে অবস্থায় ছিল এখনো সেভাবেই রয়ে গেছে। পাশপাশি বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের (প্রায়) ৬০ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ৪ লাখ মামলাও সেই একই তিমিরে রয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত এসব মামলা প্রত্যাহারের কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। ’
‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন এখনো দেশে ফিরছেন না ?’-এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘তাঁর দেশে ফিরতে কোনো বাধা নেই। তবে তিনি দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি এবং দেশের সংবিধানের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাশীল। তিনি চান- যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া (আন্ডার সিআরপিসি) মেনেই তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলার জামিন ও প্রত্যাহার কার্যক্রম সম্পন্ন হোক। তাছাড়া দল ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের সর্বশেষ কর্মীর শেষ মামলাটি প্রত্যাহারের আগ পর্যন্ত তাঁর নিজের মামলা প্রত্যাহার হোক এটাও তিনি চান না বলে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন। তবে এটাও ঠিক যে- শুধু দলীয় নেতা-কর্মীরাই নন, তারেক রহমানের আগমনের অপেক্ষায় রয়েছেন দেশের লাখো-কোটি সাধারণ মানুষ। অতএব সময় হলে তিনি অবশ্যই দেশে ফিরে আসবেন। ’
জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টি ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এখনো ৮০টির মতো মামলা ঝুলছে। প্রক্রিয়াগত ধীরগতির কারণে এখনো মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আর মামলার আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন ব্যতীত তারেক রহমান দেশে ফিরবেন না। এজন্য বিএনপির নীতিনির্ধারক মহলের সদস্যরা অব্যাহত তাগিদ দিচ্ছেন। দল ও অঙ্গ-সংগঠনের পক্ষ থেকে আন্দোলনের হুমকিও অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দুজনেই দলীয় নেতা-কর্মীদের এ বিষয়ে ধৈর্য ধরে শান্ত থাকতে বলেছেন। তবে দলের এই দুই শীর্ষনেতাও চান সারা দেশে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ৬০ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে যে (প্রায়) ৪ লাখ মিথ্যা ও গায়েবি মামলা স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ আমলে দায়ের করা হয়েছে- সেগুলো আর কালবিলম্ব না করে অন্তর্বর্তী সরকার যেন প্রত্যাহার করে নেয়।
এ বিষয়ে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মেজর অব. হাফিজউদ্দিন আহমদ বীরবীক্রম বলেন, পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা তরতাজা খুনের মামলার আসামি হয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জামিন ও মুক্তি পেয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী এম এ মান্নান ও সাবের হোসেন চৌধুরীর জামিন ও মুক্তির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতির এমন দুর্ভাগ্য যে তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মামলা প্রত্যাহার হয় না। কোটি মানুষের নেতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মাথার ওপর মিথ্যা মামলাগুলো খড়গ হয়ে ঝুলছে। সারা দেশের অর্ধ কোটিরও বেশি বিএনপি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে দায়ের করা লাখ লাখ গায়েবি মিথ্যা মামলায় এখনো তাদের আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। এগুলো কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।
একই বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসব মামলা একসঙ্গে প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত। কারণ এ লোকগুলো তো এসব মিথ্যা ও গায়েবি মামলায় টানা ১৫/১৬ বছর ধরে সাফার করেছে। এরপর তো আর এক দিনও তাদের এসব মামলায় সাফার করার কথা নয়। এ সময়ে একটা দিনও অনেক বেশি কষ্ট মনে হচ্ছে এখন। এত লড়াইয়ের মধ্যে, এত জুলুম-নির্যাতনের মধ্যেই এসব মিথ্যা মামলা দিয়েছে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এখনো মামলাগুলো চলমান রয়েছে। এটা হতে পারে না। এটা মেনে নেওয়া যায় না। এ অবস্থায় যদি একটা দিনও বেশি দেরি করা হয়- তাহলে তাদের প্রতি চরম অবিচার করা হবে। কারণ তাদের এই ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং বিশেষ অবদানের ফলেই কিন্তু আজ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। আর তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করেও স্বৈরাচারের সঙ্গে আপস করেননি। মৃত্যুর দুয়ার থেকে বারবার ফিরে এসেছেন তিনি। সাড়ে ছয় বছর মিথ্যা মামলার সাজানো রায়ে কারাবরণ করেছেন। এখনো তিনি মারাত্মকভাবে অসুস্থ। অন্যদিকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে আজ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশে আসতে দেওয়া হয়নি। মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দিয়ে তাঁকে বিদেশে নির্বাসনে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। সেখানে থেকেই দিনরাত পরিশ্রম করে তিনি দলকে শক্তিশালী ও সুসংহত করেছেন। সব রাজনৈতিক দলসহ সমগ্র জাতিকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করেছেন। হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে যার ফসল আজ বাংলাদেশের মানুষ পেতে শুরু করেছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলাগুলোই এখনো পর্যন্ত বহাল রাখা হয়েছে। এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কিছু হতে পারে না।