নগরের কোতোয়ালী থানায় দায়ের করা মাদক আইনের মামলায় জামিন পেয়েছেন কাতার প্রবাসী ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক শুকলাল শীল।
আজ সোমবার চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম জুয়েল দেবের আদালত এই আদেশ দিয়েছেন বলে জানান শুকলাল শীলের আইনজীবী প্রদীপ চৌধুরী।
এর আগে শুকলাল শীলের ‘পাঞ্জাবীর পকেটে থাকা মাম পানির বোতলে ৪০০ মিলিলিটার চোলাই মদ’ পাওয়া গেছে, দাবি করে রোববার (৫ মার্চ) কোতোয়ালী থানায় মামলা করেছেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের সার্জেন্ট শাহেদ ইকবাল।
উক্ত মামলার এজাহার ও জব্দ তালিকা নিয়েই নানা প্রশ্ন উঠেছে।
সার্জেন্ট শাহেদ ইকবালের দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, ৪ মার্চ রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে পলোগ্রাউন্ডের বাণিজ্য মেলার সামনের রাস্তায় ডিউটিকালীন সময়ে সার্জেন্ট শাহেদ ইকবালকে ফোন করেন ট্রাফিক পরিদর্শক-টিআই (কোতোয়ালী) জিয়াউল হাসান।
তখন সার্জেন্ট শাহেদ ইকবালকে টিআই জিয়াউল হাসান জানান, ‘সিএমপির ট্রাফিক উত্তর বিভাগের সার্জেন্ট সোহেল রানা ও নিউমার্কেট মোড়ে ট্রাফিক ডিউটিতে থাকা সার্জেন্ট শাহেদুল হক শাহেদ বিশ্বস্ত সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে নিউমার্কেট থেকে পলোগ্রাউন্ডগামী একটি প্রাডোতে (চট্টমেট্রো-ঘ-১১-০৭০৫) অস্ত্রশস্ত্র আছে সন্দেহে পিছু নিয়েছে। পলোগ্রাউন্ডের রাস্তায় পৌঁছলে প্রাডোটি যেন আটক করা হয়।’
এরপর রাত ৮টা ৫৫ মিনিটে প্রাডো গাড়িটি পলোগ্রাউন্ড স্কুলের মেইন গেইটের সামনে আসলে থামার সংকেত দেন সার্জেন্ট শাহেদ ইকবাল। গাড়িটি থামার সঙ্গে সঙ্গে একটি সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে ট্রাফিক উত্তর বিভাগের সার্জেন্ট সোহেল রানা ও নিউমার্কেট মোড়ে ট্রাফিক ডিউটিতে থাকা সার্জেন্ট শাহেদুল হক শাহেদ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে প্রাডো গাড়িতে তল্লাশি করেন।
এ সময় শুকলাল শীলের পাঞ্জাবীর ডান পকেটে থাকা মাম পানির একটি বোতলে ৪০০ মিলি লিটার চোলাই মদ পেয়ে সার্জেন্ট সোহেল রানা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। গাড়িটি ব্যাপক তল্লাশি করেও অস্ত্র পাওয়া যায়নি। এরপর উদ্ধারকৃত চোলাই মদসহ শুকলাল শীলকে কোতোয়ালী থানায় নেওয়া হয়।
ওইদিন রাত ১১টা ১৫ মিনিটে কোতোয়ালী থানার ডিউটি অফিসারের কক্ষে মাদক জব্দ ও জব্দ তালিকায় সাক্ষীদের স্বাক্ষর নেন কোতোয়ালী থানার মোবাইল-২১ (রাত্রিকালীন) অফিসার এসআই মোহাম্মদ ইমরান। এরপর ৫ মার্চ রাত ১২টা ২৫ মিনিটে এজাহার পেশ করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলার এজাহারই ইঙ্গিত দিচ্ছে মামলাটি সাজানো হতে পারে।
পলোগ্রাউন্ড মাঠে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলাকে ঘিরে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যাপক যানজট হয়। আর এই যানজট নিয়ন্ত্রণ করাই ট্রাফিক পুলিশের মূল দায়িত্ব। তাদেরকে ট্রাফিক বেইজড ট্রেনিং দিয়ে পারদর্শী করা হয়। অস্ত্র ও মাদকের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তাদেরকে দেওয়া হয় না। ট্রাফিক পুলিশের কেউ কখনোই ক্রাইম ইউনিটে দায়িত্ব পান না।
এরপরও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলাকে ঘিরে যানজটের কাজ বাদ দিয়ে একজন টিআই ও তিনজন সার্জেন্ট মিলে একটি প্রাডো গাড়ির পেছনে লেগে থাকা ও মাত্র ৪০০ মিলিলিটার চোলাই মদ উদ্ধারের বিষয়টি নানা রহস্যের জন্ম দিয়েছে।
সাধারণত ঘটনাস্থলেই হাতে লিখে জব্দ তালিকা তৈরি করা হয়। কিন্তু শুকলাল শীলের বিরুদ্ধে করা মামলার ক্ষেত্রে জব্দ তালিকা করা হয়েছে কোতোয়ালী থানার ডিউটি অফিসারের কক্ষে।
এজাহারের ভাষ্য মতে, চোলাই মদ উদ্ধার হয়েছে রাত ৮টা ৫৫ মিনিটের পরপরই। অথচ থানায় জব্দ তালিকা করা হয়েছে রাত ১১টা ১৫ মিনিটে। মাঝখানে সময়ের ব্যবধান ২ ঘন্টা ২০ মিনিট। অথচ ঘটনাস্থল পলোগ্রাউন্ড থেকে কোতোয়ালী থানার দূরত্ব মাত্র ২ কিলোমিটার। যেতে লাগে ১০ থেকে ১২ মিনিট।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে একজন পুলিশ কর্মকর্তা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সাধারণ মানুষ যেভাবে মাদক ধরিয়ে দিতে পারেন, তেমনি ট্রাফিক পুলিশও মাদক ধরিয়ে দিতে পারে। চোলাই মদ উদ্ধারের ঘটনা সত্যি হলে ট্রাফিক পুলিশের উচিত ছিল, ফোন করে ঘটনাস্থলেই থানার মোবাইল টিম নিয়ে আসা। এরপর মোবাইল টিমের অফিসার জব্দ তালিকা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিত। এখন বাণিজ্য মেলা কেন্দ্রীক সড়কের যানজট ফেলে একজন কোটিপতি ব্যবসায়ীর পেছনে এক টিআই ও তিন সার্জেন্টের ছোটাছুটি করা নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে, এটাই স্বাভাবিক।’
তিনি আরও বলেন, ‘অফিসারদের প্রতি নির্দেশ থাকে, জব্দ তালিকা যেন ঘটনাস্থলেই তৈরি করা হয়। এ কারণে জব্দ তালিকা সাধারণত হাতে লেখা হয়ে থাকে। কারণ ঘটনাস্থলে তো কম্পিউটার, প্রিন্টার থাকে না। এখন শুকলাল শীলের মামলায় দেখা গেল, জব্দ তালিকা থানায় ডিউটি অফিসারের রুমে করা হয়েছে। এ কাজটির কারণে শুকলাল শীল সুবিধা পাবেন।’
ঘটনাস্থলেই জব্দ তালিকা না করা প্রসঙ্গে মামলার বাদী ও ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের সার্জেন্ট শাহেদ ইকবাল একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘জব্দ তালিকা তো আমি করতে পারব না৷ তাই আমরা থানায় নিয়ে গেছি। পরে রেগুলার মামলা হয় তার নামে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্ব ফেলে তাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম না। সেদিন থানার মোবাইল টিম অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল৷ তাই ওনাকে (শুকলাল শীল) বুঝিয়ে-শুনিয়ে থানায় নিয়ে যেতে আমাদের একটু সময় লেগেছে।’ সেদিন শুকলাল শীলের পাঞ্জাবীর পকেটেই ৪০০ মিলিলিটার চোলাই মদ ছিল বলে দাবি করেন তিনি।
শুকলাল শীলের পরিবারের একজন সদস্য বলেন, ‘সার্জেন্টের কাজ গাড়ির কাগজ তল্লাশি করা। অস্ত্র বা মদ তল্লাশি করা নয়। কথিত চোলাই মদ উদ্ধারের প্রক্রিয়ায় তারা থানা পুলিশকে যুক্ত করেনি। মামলার এজাহারের বিবরণ দেখেই যে কেউ বুঝে যাবেন, এটা সাজানো মামলা।’
তিনি আরও বলেন, ‘তিনি (শুকলাল শীল) কোটিপতি। খেলে বিদেশি মদ খাবেন। ৪০০ মিলি লিটার বাংলা মদ খাওয়ার জন্য প্রাডো গাড়িতে রাখবেন না।’
শুকলাল শীল চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তিনি বর্তমানে নগরের চান্দগাঁও থানার সানোয়ারা আবাসিক এলাকায় থাকেন।
শুকলাল শীলকে ‘ফাঁসানোর কারণ’ জানিয়ে তার পরিবারের সদস্যরা বলছেন, কয়েকদিন আগে সানোয়ারা আবাসিকের বাসভবনে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার শখানেক ছাত্রলীগ কর্মীকে খাইয়েছেন শুকলাল শীল। তার এসব কাজকে সাতকানিয়ার কেউ কেউ সহ্য করতে পারছেন না। স্থানীয় রাজনীতিতে তাকে শক্ত প্রতিপক্ষ ভাবছেন। তারাই পুলিশকে প্রভাবিত করে এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন বলে তাদের ধারণা।
নীলকমল সুশীল নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘হিন্দু সমাজের দানশীল লোক শুকলাল শীল। জানামতে, তিনি বড়মাপের ধনী। আমার শ্বশুর বাড়ির পাশে হলেও কখনোই পরিচয় হয়নি শুকলাল শীলের সাথে। আজ তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হলো মাত্র ৪০০ এমএল মদের মামলা দেখিয়ে। উদ্ধার দেখানো হলো তার প্রাডো গাড়ি থেকে। বিষয়টি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের প্রয়োজন। এর পেছনের ইতিহাস কী তাও জানা দরকার। এছাড়া এই ছবি (গ্রেপ্তার হওয়ার পর দুই ট্রাফিক পুলিশসহ শুকলাল শীলের ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে) থানার বাইরে এলো কীভাবে? যেখানে থানা থেকে প্রকৃত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ছবি পেতে গণমাধ্যমকর্মীদের উপর কখনো কখনো ঝড় বয়ে যায়…অনেক সময় দেখা যায়, ছবি পেলেও ছবির চেহারা ঢাকা…..’
ফেসবুকে এম.এফ আলম চৌধুরী নামের একজন লিখেন, ‘কোটিপতির প্রাডো গাড়িতে মাত্র ৪০০ মিলি মদ! হিসাবে মিলে না। ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছি।’
শিবু নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘দেশে ভালো কিছু করতে গেলে এমন করে ফাঁসাবে। এমন একটা মানুষকে চক্রান্ত করে ফাঁসানোর দরকার ছিল না। ভগবান আছেন, যারা এই কাজটা করেছেন তাদের বিচার হবে একদিন।’
শুকলাল শীলকে ফাঁসানোর অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সিএমপির মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার (পিআর) স্পিনা রানী প্রামাণিক এ বিষয়ে কোতোয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার অতনু চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
জানতে চাইলে অতনু চক্রবর্তী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী ট্রাফিক বিভাগের কেউ যদি কোনো অপরাধ সংঘটিত হতে দেখেন তাহলে থানার মোবাইল টিমকে কল করবেন। তারা এসে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। আর মামলার জব্দ তালিকা ঘটনাস্থলেই করার নিয়ম রয়েছে। শুকলাল শীলের ঘটনায় কী হয়েছে, সেটা এখনই জানাতে পারছি না। খবর নিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি জেনেছিলাম ট্রাফিক সার্জেন্ট শাহেদ সেদিন মোবাইল টিমকে কল করেছিলেন। তারাই এসে ওই ব্যক্তিকে (শুকলাল শীল) নিয়ে যায়। চোলাই মদ তার হাতে পাওয়া গিয়েছিল বলে শুনেছিলাম।’