গত ১৪ মাসে নাটোরের বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর ১৪টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা এসব হামলা চালিয়ে নিমিষেই উধাও হয়ে গেছেন। হামলায় আহত হয়েছেন জামায়াত-বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মীরা। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
সর্বশেষ হামলাটি হয়েছে বুধবার (৩ জুলাই) সকাল ৯টায় জেলা সদরের আলাইপুর এলাকায় বিএনপি কার্যালয়ের সামনের সমাবেশে। এতে আহত হয়েছেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, নাটোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শহিদুল ইসলাম (বাচ্চু), জেলা শ্রমিক দলের দপ্তর সম্পাদক রফিক, পৌর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক সাব্বিরুল ইসলাম (চপল), পৌর বিএনপির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক মসনুর ফেরদৌস (হিপলু), থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যসচিব মিজানুর রহমান ও শ্রমিক দলের তথ্য বিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম। আহত ব্যক্তিদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
অনুসন্ধান বলছে, ২০২৩ সালের পহেলা এপ্রিল কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১০ দফা দাবি নিয়ে নাটোর বিএনপি আয়োজিত সমাবেশে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে আওয়ামী লীগ-বিএনপির ধাওয়া পাল্টাধাওয়ায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয় নাটোর শহর। ওই সংঘর্ষে আওয়ামী লীগের দুইজনসহ বিএনপির ৭ নেতাকর্মী আহত হন।
একই বছরের ২৭ মে নাটোর শহরের আলাইপুর দলীয় কার্যালয়ের সামনে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী জড়ো হতে শুরু করেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। বিএনপির ওই সরকারবিরোধী সমাবেশ চলাকালে নাটোর শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করে জেলা ছাত্রলীগ। এ সময় একদল দুর্বৃত্ত মোটরসাইকেল নিয়ে এসে ২টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় বিএনপি কার্যালয়ের সামনে। তবে ওই ঘটনায় কেউ হতাহত হননি। ওই বছরের ৩১ জুলাই দলীয় কার্যালয়ে যাওয়ার পথে ভোর নাটোর শহরের চকবৈদ্যনাথ গুড়পট্টি এলাকায় নাটোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব রহিম নেওয়াজের ওপর হামলা চালানো হয়। এই নেতাকে অচেতন হওয়া পর্যন্ত বেধড়ক পিটিয়ে সড়কে ফেলে দেওয়া হয়। একই বছরের ১৬ অক্টোবর থেকে ২১ নম্বর পর্যন্ত সময়ে নাটোর জেলাজুড়ে অন্তত দশটি হামলার ঘটনা ঘটে। এতে বিএনপি-জামায়াতের ১০ নেতাকর্মী-সমর্থকদের কুপিয়ে, পিটিয়ে, গুলি করে এবং হাতপায়ের রগ কেটে আহত করা হয়। আহতদের মধ্যে বিএনপির এক নেতার শরীরে তিনটি গুলি, দুজনের হাত পায়ের রগ কেটে দেওয়া এবং বাকি সাতজনের হাত-পা ভেঙ্গে দেয় মুখোশধারীরা। তবে আহতদের পক্ষ থেকে দশটি হামলার ঘটনায় থানায় পাঁচটি মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু হামলার সাথে কারা সম্পৃক্ত তা এখানো স্পষ্ট হয়নি।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র বলছে ১৬ অক্টোবর থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত জেলাজুড়ে যে দশটি হামলার ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে নলডাঙ্গায় ছয়টি, নাটোর সদর উপজেলায় দুটি, লালপুরে একটি ও সিংড়া উপজেলায় একটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। মুখোশধারীদের এসব হামলায় বিএনপি ও যুবদলের তিন নেতা, ছয়জন জামায়াতের এবং একজন ইসলামী আন্দোলনের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। মুখোশধারীদের এসব হামলার ঘটনা ঘটেছে সকাল এবং রাতে।
মুখোশ এবং হেলমেট পড়ে সাদা রঙের মাইক্রোবাসে তুলেই অপহৃত ব্যক্তির চোখমুখে নতুন গামছা পেঁচিয়ে নেওয়া হয় নির্জন স্থানে। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয় সড়কে। এসব হামলার সবকটিতেই মুখোশ এবং হেলমেট পরে হামলা চালানো হয়েছে। এরমধ্যে পাঁচটি হামলায় সাদা রঙের মাইক্রোবাস ব্যবহার করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগীর স্বজনেরা।
আহত ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাতের আঁধারে পথ রোধ করে হামলা চালিয়েছে মুখোশধারীরা। আবার সাদা রঙের মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে হাত-পা ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। কেটে দেওয়া হয়েছে পায়ের রগ। চালানো হয়েছে গুলি। এছাড়া নয়জন নেতাকর্মীর ওপর পৃথকভাবে নয়টি হামলার সময় লোহার রড, চায়নিজ কুড়াল ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় হামলাকারীরা মুখোশধারী ছিল।
ভুক্তভোগী ও স্থানীয় সূত্র বলছে, ১৬ অক্টোবর রাত আটটার দিকে নলডাঙ্গায় ওই মাসের প্রথম হামলার ঘটনাটি ঘটে। নলডাঙ্গা জামায়াতে ইসলামীর পৃষ্ঠপোষক ও অর্থ যোগানদাতা নাসির উদ্দিন সরকার (৬৫) মোটরসাইকেল নিয়ে বাঁশিলায় নিজের বাড়িতে ফেরার সময় সোনাপাতিল তালতলায় মুখোশধারীদের হামলার শিকার হন।
২৫ অক্টোবর রাত পৌনে নয়টার দিকে দ্বিতীয় হামলার ঘটনায় জামায়াতের কর্মী পল্লিচিকিৎসক আলাউদ্দিনকে (৬০) নলডাঙ্গার একটি সড়কে পিটিয়ে জখম করা হয়। নলডাঙ্গা উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ফজলুর রহমানের (৬৫) ওপর হামলা হয় এর পরদিন। বিএনপির অবরোধ চলাকালে ২৯ অক্টোবর সকালে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলাম বাড়ির সামনে গুলিবিদ্ধ হন। মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা তার শরীরে তিনটি গুলি করেন। সাইফুল ইসলাম এখনো রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
৩০ অক্টোবর রাতে বাড়ি থেকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে নলডাঙ্গার খাজুরা ইউনিয়ন জামায়াতের আমির মোশারফ হোসেনকে (৭৪) হাত-পা ভেঙে সড়কের পাশে ফেলে দেওয়া হয়। ৩ নভেম্বর রাতে লালপুর উপজেলার বিলমাড়িয়া এলাকা থেকে ওই ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ সরকারকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে হাত-পায়ের রগ কেটে সড়কে ফেলে রাখা হয়। ১২ নভেম্বর নলডাঙ্গায় এক যুবদল নেতাকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে হাতুড়িপেটা করে হাত-পা ভেঙে দেয় দুর্বৃত্তরা। তিনি ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত।
নাটোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব রহিম নেওয়াজ বলেন, আন্দোলন সংগ্রাম থেকে দুরে রাখতেই আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর এভাবে হামলা চালানো হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যের পালিত সন্ত্রাসীরাই এসব হামলার সাথে জড়িত। যারা হামলা করেছে, তারা চিহ্নিত। একের পর এক হামলার পরও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় সন্ত্রাসীরা নতুন করে হামলা করার সাহস পাচ্ছে।
নাটোর পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম বলেন, কারা হামলা চালিয়েছে, তা উদ্ঘাটনে পুলিশ কাজ করছে। প্রতিটি হামলারই সুষ্ঠু তদন্ত করা হচ্ছে।