দূর্গাপূজার মণ্ডপে বাজানো গান-বাজনা, মাইক বা স্পিকারের আওয়াজ আজান ও নামাজের সময় সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজে যেন নামাজে ব্যাঘাত না ঘটে, সেজন্য এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে নামাজের সময়ের পর যথারীতি পূজার বাদ্য-বাজনা চলবে। গত মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সচিবালয়ে পূজা উদযাপন পরিষদের নেতাদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এই বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
ওই বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, পূজা উদযাপন কমিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। নামাজ ও আজানের সময় পূজামণ্ডপে চলা গান-বাজনা বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। মণ্ডপে পুরোহিত না থাকলে অন্যকেউ যেন এইসময় এসে বাদ্য-বাজনার আওয়াজ না করে, সেটিও তারা লক্ষ্য রাখবেন।
তবে এই বিষয়টিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করছে একাধিক ভারতীয় গণমাধ্যম। যেমন এইসময় লিখেছে, ‘নমাজের সময় বন্ধ রাখতে হবে ঢাক-বাদ্যযন্ত্র, দুর্গাপুজোর আগে ফরমান বাংলাদেশের।’ সংবাদমাধ্যমটি আরও উল্লেখ করেছে, ‘অনেকের মতে, এই রকম নির্দেশ দিয়ে হিন্দুদের উপর চাপ তৈরি করতে চাইছে মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার।’
দ্য হিন্দুস্তান টাইমস বাংলা লিখেছে, ‘হাসিনার পতনের পর দুর্গাপুজোর সময় যাতে নতুন করে অশান্তি না ছড়ায় তা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই দানা বেঁধেছে নয়া বিতর্ক। কী সেই সিদ্ধান্ত?’
হিন্দুস্তান টাইমস বাংলা আরও উল্লেখ করে, ‘তাহলে কি শেখ হাসিনার সরকার পড়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশে দুর্গাপুজো করার মতো সুস্থ পরিবেশ নেই? একথা মানতে নারাজ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধিরা। তাঁরা জানান, পুজো মণ্ডপগুলির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি যাতে পুজোর সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও অক্ষুণ্ণ থাকে, সেদিকেও নজর রাখা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, দুর্গাপুজোর সময় বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক অশান্তি নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে এই ধরনের ঘটনা অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছে। এমনকী, তাতে একাধিক জীবনহানির ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। তথ্যাভিজ্ঞ মহলের একাংশের আশঙ্কা, হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে দুর্গাপুজো চলাকালীন অশান্তি আরও বাড়তে পারে। কারণ, ইতিমধ্যেই সেদেশের সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। প্রাণ বাঁচাতে অনেকেই যে কোনও মূল্যে ভারতে পালিয়ে আসার মরিয়া চেষ্টা করছেন।’
অন্যদিকে ভারতীয় মিডিয়া দ্য হিন্দু এ সংক্রান্ত খবরের শিরোনাম করেছে, ‘বাংলাদেশে নামাজ-আজানের সময় হিন্দুদের দুর্গাপূজার কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বলেছে’।
হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বরাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, পূজা কমিটিগুলো
প্রকৃতপক্ষে দূর্গাপূজার কোনো কার্যক্রম বন্ধ রাখার ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার। বরং নামাজের সময় যেন ঢাকঢোলের শব্দে মসজিদে নামাজ আদায়ে কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য সাময়িক সময়ের জন্য বাদ্যযন্ত্র বা মাইকের আওয়াজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। এই বিষয়টিকে কোথাও কোথাও ভিন্নভাবে উপস্থাপন করায় মনে হতে পারে দূর্গাপূজা আয়োজনে বাঁধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। অথচ বাস্তবে এমন কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি, যা পূজার আয়োজনকে বাঁধাগ্রস্ত করবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, এ বছর সারা দেশে মোট ৩২ হাজার ৬৬৬টি পূজামণ্ডপ তৈরি করা হবে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ১৫৭টি এবং উত্তর সিটি করপোরেশনে ৮৮টি মণ্ডপ হবে। গত বছর পূজামণ্ডপের সংখ্যা ছিল ৩৩ হাজার ৪৩১টি। প্রতিমা তৈরির সময় থেকে শুরু করে উৎসবে নিরাপত্তার আশ্বাসও দেন লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, আমরা আলোচনা করেছি কিভাবে পূজামণ্ডপে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। কোনো বাধা ছাড়াই পূজা উদযাপনের সুবিধার্থে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং দুর্বৃত্তদের অশুভ কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করা হবে। এসময় তিনি বলেন, আজান ও নামাজের সময় পূজামণ্ডপের বাদ্যযন্ত্র বন্ধ রাখতে হবে। আজানের পাঁচ মিনিট আগে থেকে বাদ্যযন্ত্র বন্ধ করতে হবে।
অন্যদিকে ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেছেন, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। সেই পূজা নির্বিঘ্নে করতে মাদ্রাসার ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করতে রাজি। পূজা কমিটি যদি চায় তারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে সম্মত আছে। শুধু তাই নয়, দুর্গাপূজার সময় নিরাপত্তায় আকাশে হেলিকপ্টার থাকবে। দশমীর দিন ডুবুরি থাকবে। দুর্গাপূজার অনুদান ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা করে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
এদিকে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জাতি। ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করে এমন কোনো কাজ কেউ করবে না, কাউকে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া উচিত নয়। কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করলে অবশ্যই তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।