‘নতুন বাংলাদেশের’ সাথে নতুনভাবে বিশ্ববাসীকে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান ইউনূসের

0
8

বিশ্ব সম্প্রদায়কে নতুন বাংলাদেশের সাথে নতুনভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেয়া ভাষণে এ আহ্বান জানান তিনি।

শুক্রবার নিউইয়র্ক সময় সকালে সাধারণ পরিষদের ৭৯-তম অধিবেশনে সরকারপ্রধান হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূস নিজের প্রথম ভাষণ দিলেন।

সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা দেয়ার বিগত সময়ের রেওয়াজ অব্যাহত রেখেছেন তিনি।বক্তব্যে অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা বলেন।

বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ও সরকার পতন আন্দোলনকে তিনি ‘মনসুন রেভোল্যুশন’ বা ‘মনসুন অভ্যুত্থান’ বলে আখ্যা দেন।

তার সরকারের গৃহীত সংস্কার কার্যক্রম ও লক্ষ্য সম্পর্কেও ধারণা দেন তিনি।

“আমাদের দেশের মানুষ মুক্তভাবে কথা বলবে, ভয়-ভীতি ছাড়া সমাবেশ করবে, তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে – এটাই আমাদের লক্ষ্য,” বলেন অধ্যাপক ইউনূস।

ইসরায়েল-গাজা, ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বৈশ্বিক সংকট উঠে আসে তার বক্তব্যে।

‘ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধ হচ্ছে’ উল্লেখ করে আহ্বান জানান ‘সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতির’।

এছাড়া, রোহিঙ্গা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, অভিবাসন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা নিয়েও কথা বলেন মুহাম্মদ ইউনূস।

তিনি বলেন, দ্বিপাক্ষিক চুক্তিসহ সকল আন্তর্জাতিক চুক্তি মেনে চলার ব্যাপারে তার সরকার বদ্ধপরিকর।

‘একাত্তরের মূল্যবোধকে নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে জেন-জি’
অধ্যাপক ইউনূস তার ভাষণের শুরুতেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদলের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশীদারিত্ব চেয়েছিল। আমাদের জনগণ একটি ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, যার জন্য আমাদের নতুন প্রজন্ম জীবন উৎসর্গ করেছিল।”

ছাত্র ও যুব সমাজের আন্দোলন প্রথমদিকে মূলত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হলেও পর্যায়ক্রমে তা গণআন্দোলনে রূপ নেয় বলে উল্লেখ করেন মি. ইউনূস।

তার ভাষ্য, এই গণআন্দোলন রাজনৈতিক অধিকার ও উন্নয়নের সুবিধা বঞ্চিত বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে।

“উদারনীতি, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার উপর মানুষের গভীর বিশ্বাস থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭১ সালে যে মূল্যবোধকে বুকে ধারণ করে আমাদের গণমানুষ যুদ্ধ করেছিল, সেই মূল্যবোধকে বহু বছর পরে আমাদের ‘জেনারেশন জি’ (প্রজন্ম জি) নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে।”

বলেন, আমাদের ছাত্রজনতা তাদের অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয়ের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি এনে দিয়েছে।

জুলাই-অগাস্টের আন্দোলনকে ‘মনসুন অভ্যুত্থান’ বলে অভিহিত করেন অধ্যাপক ইউনূস
‘নতুন বাংলাদেশ’
বাংলাদেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, সকল রাজনৈতিক দল স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারছে বলে মন্তব্য করেন অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান।

“আমরা মানুষের মৌলিক অধিকারকে সমুন্নত ও সুরক্ষিত রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমাদের দেশের মানুষ মুক্তভাবে কথা বলবে, ভয়-ভীতি ছাড়া সমাবেশ করবে, তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে – এটাই আমাদের লক্ষ্য,” যোগ করেন অধ্যাপক ইউনূস।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রব্যবস্থার সকল পর্যায়ে সুশাসন ফিরিয়ে আনাই তার সরকারের অভীষ্ট।

জুলাই-অগাস্টের আন্দোলনকে ‘মনসুন রেভোল্যুশন’ বা ‘মনসুন অভ্যুত্থান’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষকে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে প্রেরণা যুগিয়ে যাবে।

“আমাদের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমি তাই বিশ্ব সম্প্রদায়কে নতুন বাংলাদেশের সাথে নতুনভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানাই,” বলেন মি. ইউনূস।

ইসরায়েল-গাজা ও ইউক্রেন প্রসঙ্গ
বৈশ্বিক যুদ্ধ-সংঘাতের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়েও কথা বলেন অধ্যাপক ইউনূস।এতে ব্যাপকভিত্তিতে মানুষের অধিকার খর্ব হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, “বিশ্ববাসীর উদ্বেগ এবং নিন্দা সত্ত্বেও গাজায় গণহত্যা থামছে না। ফিলিস্তিনের বিদ্যমান বাস্তবতা কেবল আরব কিংবা মুসলমানদের জন্যই উদ্বেগজনক নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্যই উদ্বেগের।”

“ফিলিস্তিনের জনগণের বিরুদ্ধে যে মানবতা বিরোধী অপরাধ হচ্ছে, তার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে দায়বদ্ধ করতে হবে। ফিলিস্তিনের জনগণের উপর চলমান নৃশংসতা, বিশেষত নারী এবং শিশুদের সাথে প্রতিনিয়ত যে নিষ্ঠুরতা বিশ্ব দেখছে, তা থেকে নিস্তারের জন্য বাংলাদেশ অনতিবিলম্বে সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছে,” যোগ করেন মি. ইউনূস।

দ্বি-রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানই মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তি আনতে পারবে বলে মন্তব্য করে তিনি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এর জন্য এখনই উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান।

বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা কথা বলেন ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও। যদিও যুদ্ধের বিষয়ে রাশিয়ার নাম উল্লেখ করেননি তিনি।

“এই যুদ্ধের প্রভাব সর্বব্যাপী। এমনকি বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব অনুভূত হচ্ছে,” বলেন অধ্যাপক ইউনূস।উভয়পক্ষকেই সংলাপে বসে বিরোধ নিরসনের মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম আলোচিত ও সমালোচিত দিক অর্থ পাচার।

অর্থ পাচার ইস্যুও উঠে আসে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে।তিনি বলেন, অবৈধ অর্থের প্রবাহ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে সম্পদের পাচার বন্ধ করা অত্যাবশ্যক।”উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে পাচার হয়ে যাওয়া সম্পদ ফেরত আনার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করতে হবে। আমরা আশা করি যে, কর ফাঁকি রোধে আন্তর্জাতিক কর কনভেনশন অতিশীঘ্রই গৃহীত হবে,” বলেন মুহাম্মদ ইউনূস।

বাংলাদেশের সরকার প্রধান জানান, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এ মুহূর্তে প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি আছেন।

সকলের জন্য অভিবাসনের উপযোগিতা নিশ্চিত করতে বিশ্বসমাজকে নিরাপদ, সুশৃঙ্খল, নিয়মিত এবং মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসনের পথ সুগম করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, অনিরাপদ অভিবাসন রোধে বাংলাদেশ বদ্ধ পরিকর।বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সংকটের নাম রোহিঙ্গা ইস্যু।

মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গারা যাতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করে তাদের নিজ ভূমি – রাখাইনে – ফিরে যেতে পারে, তার পথ সুগম করা দরকার।

“মিয়ানমারে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল অবস্থা বিবেচনায় রেখে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে একযোগে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য পরিবেশ সৃষ্টিতে কাজ করতে প্রস্তুত,” যোগ করেন তিনি।

তরুণদের কর্মসংস্থান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রসঙ্গে বিশেষ সতর্কতা গ্রহণের কথা বলেন অধ্যাপক ইউনূস।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মতো বৃহৎ তরুণ জনগোষ্ঠীর দেশ যাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগজনিত অর্জিত সুফল থেকে পিছিয়ে না পড়ে, বিশ্ব সম্প্রদায়কে তা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে, নিশ্চিত করতে হবে যেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে কর্মক্ষেত্রে মানুষের চাহিদা সংকুচিত হয়ে না যায়।”

“আমাদের ধারণা অটোনমাস ইন্টেলিজেন্স (যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজেই নিজের কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তাকে সম্প্রসারিত করতে পারে, মানুষের কোনো হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে) মানুষের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে,” যোগ করেন মি. ইউনূস।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে ২৪শে সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে যান মি. ইউনূস।সেখানে গত কয়েকদিনে বিভিন্ন রাষ্ট্র, সরকার ও সংস্থার প্রধানদের সাথে বৈঠক করেন তিনি।এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন অধ্যাপক ইউনূস।

এছাড়া জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, আইএমএফ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভা, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর করিম এ এ খানের সাথে বৈঠক করেছেন তিনি।

আরও সাক্ষাৎ করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলিসহ আরো কয়েকজন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের সাথেও।