আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পরপরই ভারতে পালিয়ে যাওয়া চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপপরিচালক বিদ্যুৎ বড়ুয়া পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাশিয়া চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়ার ভাই। এই ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে বিদ্যুৎ বড়ুয়া গড়েছেন বিপুল সম্পদ। দুর্নীতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল টাকা। ইতিমধ্যে স্ত্রী ও বড় ভাইসহ তার ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতাধীন আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট।
এর চারদিন পর ২৬ আগস্ট চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানায় আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া ও তার ভাই বিদ্যুৎ বড়ুয়াসহ ২০২ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ভারত অবস্থানরত একটি সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে শারমিন আক্তার নামের এক বান্ধবীকেও কলকাতায় নিয়ে গেছেন বিদ্যুৎ বড়ুয়া। চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে আসা টোকেন ও ভিসা পেইজে দেখা যায়, সেই বান্ধবী গত ৫ সেপ্টেম্বর ভারতীয় ভিসার জন্য আবেদন করেন। এর মাত্র তিনদিন পর ৮ সেপ্টেম্বর তিনি মেডিকেল ভিসা পেয়ে যান। অথচ জানা গেছে, তার কোনো মেডিকেল হিস্ট্রিই ছিল না। মূলত বিপ্লব ও বিদ্যুৎ বড়ুয়ার বিশেষ তৎপরতায় দ্রুততম সময়ে এই ভিসা মিলেছে বলে জানা যায়। ভারতীয় ভিসা পাওয়ার দিনই শারমিন কলকাতা চলে যান বিদ্যুৎ বড়ুয়ার কাছে।
জানা গেছে, গত ৭ জুলাইও ভারতে গিয়েছিলেন বিদ্যুৎ বড়ুয়া। ওই সময় ‘ব্যক্তিগত কারণে ভারত যেতে হচ্ছে’ বলে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটিও নেন। তার ভিসার মেয়াদ আরও অবশিষ্ট থাকায় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর পরই বিপ্লব বড়ুয়ার পাশাপাশি বিদ্যুৎও ভারতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। সদ্য পদত্যাগ করা উপাচার্য ইসমাইল খানকে প্রভাবিত করে ভারত থেকেই ‘শারীরিক অসুস্থতা’ দেখিয়ে দুই মাসের ছুটির আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন বিদ্যুৎ বড়ুয়া— বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। তবে সহসা তার আর বাংলাদেশে ফেরা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র।
ব্যাংক একাউন্ট জব্দ, লোহাগাড়ায় মামলা
গত ২২ আগস্ট সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া এবং তার ভাই বিদ্যুৎ বড়ুয়া ও তার স্ত্রী অগ্নি বড়ুয়ার ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়। এছাড়া রাউজান বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক এইচএম জামাল উদ্দিনের ব্যাংক হিসাবও স্থগিত করা হয়। জামাল বিদ্যুৎ বড়ুয়ার ব্যবসায়িক অংশীদার বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতাধীন আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা বিএফআইইউ ব্যাংক হিসাব স্থগিতের এ নির্দেশনা দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠিয়েছে।
বান্ধবীকে নিয়ে বিদ্যুৎ বড়ুয়া বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার পার্শ্ববর্তী বারাসাত শহরের একটি বাসায় থাকছেন। যদিও বিদ্যুৎ বড়ুয়ার স্ত্রী ও সন্তান এখনও ঢাকাতেই আছেন। বারাসাতেই অন্য একটি বাসায় তার বড় ভাই শেখ হাসিনার সাবেক বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া আছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর শারমিন আক্তার নামের মেয়েটির সঙ্গে বিদ্যুৎ বড়ুয়ার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। পরে দক্ষিণ খুলশী ১ নম্বর রোডের একটি ফ্ল্যাট দখল করে তারা একসঙ্গে থাকা শুরু করেন— এমন প্রমাণও মিলেছে সিসিটিভি ফুটেজে। প্রভাব খাটিয়ে তার আপন চাচাতো ভাইকেও চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ড্রাইভার পদে চাকরি দিয়েছেন বিদ্যুৎ বড়ুয়া। ২০২২ সালে চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানায় নিজের ভাইয়ের স্ত্রীকে নির্যাতনের অভিযোগে শারমিনের বিরুদ্ধে একটি মামলা হলেও আওয়ামী লীগ নেতাদের দিয়ে প্রভাব খাটিয়ে সেই মামলা থেকে তার নাম প্রত্যাহার করা হয়। জানা গেছে, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সোলায়মান শেঠ ও পটিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা আইয়ুব আলীর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে তার।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইয়ের জোর
অভিজ্ঞতা ছাড়াই চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-পরিচালক হিসেবে ৪৫ বছর বয়সে সরাসরি পঞ্চম গ্রেডে নিয়োগ পাওয়া বিদ্যুৎ বড়ুয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে শুরু থেকেই। তার বড় ভাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়ার প্রভাবে এই নিয়োগ পান বিদ্যুৎ বড়ুয়া। এই প্রভাব খাটিয়ে উপ-পরিচালক হয়েও চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ বড়ুয়ার ‘ক্ষমতা’ যেন উপাচার্যের চেয়েও বেশি ছিল। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড থেকে আর্থিক বিষয়াদি, যানবাহন, রেস্টহাউজ ও গেস্ট হাউস সবকিছুই তার একক নিয়ন্ত্রণে চলে আসছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডার ও কেনাকাটার নিয়ন্ত্রণও শুরু থেকেই ছিল তার হাতে। আবার টাকার বিনিময়ে নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগও আছে বিদ্যুতের বিরুদ্ধে। এর বেশকিছু প্রমাণ চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে সংরক্ষিত রয়েছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের অনিয়মকেই যেন নিয়মে পরিণত করেছেন বিদ্যুৎ বড়ুয়া। কোনো কমিটির সদস্য না হওয়ার পরও প্রতিটি মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং কলেজের সভা থেকে তিনি ভাতা গ্রহণ করে আসছিলেন নিয়মিত। এ নিয়ে ডাক্তারদের মধ্যেও ক্ষোভ আছে। এমনকি শুধু প্রকল্প ছড়ি ঘোরানোর লোভে ইঞ্জিনিয়ারিং দপ্তরের দায়িত্বও তিনি নিজের ঘাড়ে নিতে দ্বিধাবোধ করেননি।
জানা গেছে, পাহাড়তলীর রোজভ্যালি আবাসিক এলাকায় মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউজটিও রয়েছে বিদ্যুৎ বড়ুয়ার দখলে ছিল এতোদিন। ওই গেস্ট হাউজটির মালিক আবার উপাচার্য ইসমাইল খানের ভাই আজম খান। বেশি ভাড়া দেখিয়ে ভাইয়ের ফ্ল্যাট গেস্ট হাউজ হিসেবে ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে উপাচার্যের বিরুদ্ধে। এতো কিছুর পর আবার চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২২-২০২৩ সালের শুদ্ধাচার পুরস্কারটিও উপ-পরিচালক বিদ্যুৎ বড়ুয়া নিজের করে নিয়েছিলেন।
খুলশীতে ফ্ল্যাট দখলের অভিযোগ
বিদ্যুৎ বড়ুয়ার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম নগরীর দক্ষিণ খুলশী এলাকায় একটি ফ্ল্যাট জোর করে দখলে রাখার অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, দক্ষিণ খুলশী ১ নম্বর রোডে ভূমিমালিক কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ সাইফুদ্দিন ২০১৩ সালে ভবন নির্মাণের জন্য নিফকো প্রপার্টিজ নামের একটি ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেন। নিফকো প্রপার্টিজের মালিক এইচএম জামাল উদ্দিন বিদ্যুৎ বড়ুয়ার ব্যবসায়িক অংশীদার এবং রাউজান বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক।পরে ডেভেলপার হিসেবে এইচএম জামাল তার অংশের ছয়টি ফ্ল্যাটের পাঁচটিই বিক্রি করে দেন। কিন্তু ভূমিমালিকের অংশের ছয়টি ফ্ল্যাটের কাজ অসমাপ্ত রেখে দেন। পরে তিনি ডেভেলপারের অংশে পড়া একটি খালি ফ্ল্যাটে ভূমিমালিক তালা লাগিয়ে দেন। এ অবস্থায় সেই খালি ফ্ল্যাটের দখল নিতে ডেভেলপার জামাল উদ্দিন তার ব্যবসায়িক অংশীদার বিদ্যুৎ বড়ুয়ার সঙ্গে একটি ‘চুক্তি’ করেন। ২০২১ সালে সেই ‘চুক্তি’র পরপরই তালা ভেঙে বিদ্যুৎ সেই ফ্ল্যাটের দখল নেন। ওই ফ্ল্যাটে তার বান্ধবী হিসেবে পরিচিত শারমিন আক্তার নামের এক নারীকে রাখা হয়। বিদ্যুৎ বড়ুয়াসহ আরও বিভিন্ন লোকের সেখানে আসা-যাওয়া ছিল। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার কিছুদিন আগে স্ত্রী অগ্নি বড়ুয়া বিষয়টি জানতে পারলে বিদ্যুৎ বড়ুয়া ফ্ল্যাটটি থেকে ওই মেয়েকে অন্যত্র সরিয়ে নেন। পরে তিনি আরেকটি পরিবারকে সেখানে তুলে দেন। ভূমিমালিক সৈয়দ সাইফুদ্দিন বলেন, ‘ডেভেলপার আমাকে কাজ বুঝিয়ে দেয়নি, তাই আমি একটি ফ্ল্যাটে তালা দিয়েছিলাম। বিদ্যুৎ বড়ুয়া সেই তালা ভেঙে ফ্ল্যাটটি দখল করার পর আমি খুলশী থানায় জিডিও করেছি। ডেভেলপারকেও উকিল নোটিশ দিয়েছি। এতদিন বিদ্যুৎ বড়ুয়ার ভয়ে কোনো প্রতিবাদও করতে পারিনি।’