রাজধানীর সেগুনবাগিচার বটতলা এলাকায় নাভানা সিএনজির সামনের সড়কে পার্ক করে রাখা একটি প্রাইভেটকার থেকে সিয়াম (১৯) ও রাকিব (২৬) নামে দুই তরুণের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মরদেহ দুটি উদ্ধার করা হয়। মরদেহ উদ্ধারের সময় গাড়িটি কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। কাপড়টি কারা, কিভাবে দিল তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
ঘটনাটি আত্মহত্যা, খুন না-কি তারা অন্য কোনোভাবে মারা গেছেন- এসব বিষয় সামনে রেখে কাজ করছে পুলিশের একাধিক ইউনিট।
পুলিশ জানায়, ওই দুইজন যখন গাড়ির ভেতরে ঘুমাচ্ছিলেন তখন কে বা কারা বাইরে থেকে গাড়িটি কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, কালো কাপড়ে গাড়িটি ঢাকা থাকায় ওই দুই তরুণ গাড়ির ভেতরে বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টির কারণে দম বন্ধ হয়ে মারা যেতে পারেন। মরদেহ উদ্ধারের সময় দুইজনের মুখ ও নাক দিয়ে সাদা ফেনা জাতীয় কিছু বের হতে দেখা গেছে।
এরপর থানা পুলিশ, ডিবি, সিআইডি, পিবিআই, র্যাব ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা দুই তরুণের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে অনুসন্ধানে নামে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুই তরুণ যখন গাড়ির ভেতরে ঘুমাচ্ছিলেন তখন গাড়ির গ্লাস ও দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা ছিল। এরপরে কালো কাপড় দিয়ে পুরো গাড়ি ঢেকে দেওয়ায় তীব্র বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হতে পারে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কালো কাপড় সরিয়ে ওই দুইজনকে ডেকে সাড়া না পেলে গ্যারেজের মালিক নিজেই কৌশলে দরজা খুলে অচেতন অবস্থায় তাদের উদ্ধার করেন। এরপর টহল পুলিশকে ডেকে মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
কাজলরেখা নামে এক নারী ওই এলাকায় গৃহকর্মীর কাজ করেন। তিনি জানান, জহির নামে তার এক ভাতিজা গ্যারেজে কাজ করেন। সেই হিসেবে গ্যারেজে মৃত দুজনসহ আরও অনেককে তিনি চেনেন। ৩০ আগস্ট রাত ৯টার দিকে কাজ শেষে তিনি যখন ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখনো মৃত দুজনসহ অন্যদের গাড়িতে রঙ করতে দেখেন। কাজল থাকা অবস্থাতেই মৃত দুজনকে জহির বলেন, তোমরা এখন যাও। তোমাদের এখন ছুটি। এরপর তিনিও চলে যান।
কাজলরেখা বলেন, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে তিনি ওই গ্যারেজের সামনের চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিলেন। সকাল ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে গ্যারেজের মালিক বাচ্চু ও জহির এসে দুজনকে গাড়িতে ধাক্কা দিয়ে ডাকতে থাকেন। তাদের কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে আরও জোড়ে ডাকাডাকি শুরু করেন তারা। তাদের ডাকাডাকির কারণে আশপাশের লোকজন এসে জড়ো হন। বটতলায় থাকা টহল পুলিশকেও ডেকে আনা হয়। তাদের উপস্থিতিতেই বিকল্প উপায়ে গাড়ির দরজা খোলা হয়। এরপর তাদের অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ঢামেকে পাঠানো হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে কাজলরেখা বলেন, গাড়িটি কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া ছিল। এটা কে দিলো, সেটাই জানা দরকার আগে। সবার ধারণা, গ্যাস জমে তাদের মৃত্যু হয়েছে।
শাহবাগ থানার টহল পুলিশের কনস্টেবল শাহীন শাহ বলেন, আমরা সকাল থেকে বটতলায় ডিউটিতে ছিলাম। দুজন কাঁদতে কাঁদতে আমাদের কাছে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে এসে গাড়ির দরজা খুলে দেখি দুজন অচেতন অবস্থায় দুই সিটে পড়ে আছে। নাকে মুখে সাদা ফেনা ছিল। এরপর তাদের বের করে সিএনজিতে করে ঢামেকে পাঠানো হয়।
নাভানা সিএনজির নিরাপত্তারক্ষী ওমর ফারুক বলেন, নাভানা সিএনজির গ্যারেজের গেট বিকেল ৫টায় বন্ধ করা হয়। এরপর ছোট পকেট গেট খোলা থাকে। তবে সড়কের কোনো গাড়ি তাদের গ্যারেজের নয়। সড়কের ফুটপাতে বাচ্চু ও জহির বিভিন্ন মানুষের গাড়ি মেরামত করতেন। তারা বিশেষ করে গাড়ির ও গ্লাস রঙ করতেন।
গ্যারেজের মালিক বাচ্চু বলেন, মৃত সিয়াম মজুমদারের বাড়ি কুমিল্লার লালমাই উপজেলায়। জহিরের সহকারী হিসেবে কাজ করত সে, আর ধোলাইপাড় এলাকায় চাচা জহিরুলের বাসায় থাকত। মৃত আরেকজন রাকিবের বাড়ি ফরিদপুর সদর উপজেলার মুন্সিডাঙ্গা গ্রামে। সে নন্দীপাড়া আমার বাসাতেই থাকত। সোমবার রাতে কাজ শেষে দুজনই গ্যারেজের গাড়িতে ঘুমায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৃত রাকিব ও সিয়াম দুজনই গাড়িতে রঙ করার কাজে সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। জহিরের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন সিয়াম আর বাচ্চুর সহযোগী ছিলেন রাকিব। গতরাতে তারা দুজনই মেরামত করার জন্য পার্কিং করে রাখা একটি গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েন। নাভানা সিএনজির সঙ্গে এই গ্যারেজের কোনো সম্পর্ক নেই। বাচ্চু এবং জহির দুজন মিলে সড়কের উপর কোনো ধরনের দোকান বা গ্যারেজ না রেখেই গাড়ি মেরামত করতেন।
জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুদ হাওলাদার জাগো নিউজকে বলেন, দুইজন তরুণের মৃত্যুর ঘটনাটি একেবারে রহস্যজনক মনে হচ্ছে। কী কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে তা জানতে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্যারেজের মালিকসহ বেশ কয়েকজনকে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গাড়ির মালিককে ডেকে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এলে মৃত্যুর মূল রহস্য উদঘাটন করা সহজ হবে।
জানতে চাইলে রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. সাজ্জাদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, গাড়িটি কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। কিন্তু কাপড়টি কিভাবে এলো, কে দিলো তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। ফুটেজ পেলে পর্যালোচনা সাপেক্ষে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।