কিশোর অবক্ষয় রোধে অভিভাবকদের সচেতনতা

    0
    69


    এস এম আবুহানিফা সিদ্দিকী

    সন্তান সন্ততি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক মহান নেয়ামত । যার সন্তান নেই , সেই বুঝে সন্তান না থাকার কত কষ্ট। কত যন্ত্রনা , কত বেদনা । আল্লাহ তায়ালা যাকে চান পুত্র সন্তান দান করেন, যাকে চান কন্যা সন্তান দান করেন , যাকে চান পুত্র ও কন্যা উভয়ই দান করেন , যাকে চান কিছুই দান করেন না । আল্লাহ তায়ালা মানুষকে ধন সম্পদ ও সন্তান সন্ততি দিয়ে পরীক্ষা করেন । এগুলোকে সৎ উপায়ে উপযুক্ত ভাবে ব্যবহার করার মাঝেই রয়েছ মানব জীবনের সার্থকতা।
    প্রজনন ক্রিয়ার মাধ্যমে বংশ বিস্তার অন্যান্য প্রানী ও করে , তাহলে মানুষ ও অন্যান্য প্রানীর মাঝে পার্থক্য কোথায় ? নীতি নৈতিকতা ও বিবেক বুদ্ধিমত্তা আছে বলেই মানুষ অপরাপর সৃষ্টির উর্দ্ধে – আশরাফুল মাখলুকাত । সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির দিকে খেয়াল রাখা যেমন জরুরী , তেমনি নৈতিকতার উন্নয়নের দিকে খেয়াল রাখা ও প্রয়োজন।
    পুঁজিবাদী বিশ্বে যেনতেন ভাবে পুঁজি উপার্জনের অশুভ প্রতিযোগীতায় লিপ্ত বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ । আমার কলিগ বিভাগীয় শহরে ফ্ল্যট কিনছে ২ টা, বাড়ী কিনছে ১ টা। আমি কেন পারব না? আমার বন্ধুর রেয়াজুদ্দীন বাজার দোকান আছে ৪ টা , সানমারে আছে ৩ টা । হায় রে- আমি তো অনেক পিছিয়ে । আমি পাবলিক বাসে চড়ে অফিসে যাই , আর আমার বন্ধু প্রাইভেট কারে করে অফিসে যায় । এই ধরনের চিন্তা-চেতনা থেকে মানুষ শুধু অর্থের পিছনে ছুটছে , ভুলে গেছে মানবতা , বিবেক, নীতি নৈতিকতা ।
    যদ্দরুন , এর প্রভাব পড়ছে পরিবার , সমাজ, রাষ্ট্র তথা জীবনের সর্বস্তরে। অন্যায় , দুর্নীতি করে যারা অবৈধ টাকা পয়সার পাহাড় করে আছেন, তাদের সন্তানদের বিলাস বহুল লাইফ স্টাইল দেখে অন্য সন্তানেরা ও মা বাবার কাছে আবদার করে । কিন্তু তাদের মা বাবারা তো দুই নম্বরি পয়সা কামাই করতে পারে নি , যার ফলে তাদের সন্তানদের অযাচিত আবদার কোনক্রমেই পূরণ করতে পারেন না ।
    কিছু দিন আগে পত্রিকায় দেখলাম ১০ম শ্রেনীর এক ছাত্র মোটর সাইকেল কিনে না দেওয়ায় আত্বহত্যা করল। কি সাংঘাতিক ব্যাপার। এই প্রবণতার পিছনে অনেক গুলো বিষয় দায়ী । মা বাবারা ও অনেক বেশী আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে, ।
    পরিবার হচ্ছে শিশুর প্রাথমিক শিক্ষালয়। নৈতিকতা শিক্ষার কাজটি প্রথমে পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে । সন্তানকে বুঝাতে হবে যে , মা বাবার ইনকাম যতটুকু , তাতেই পরিবারের যাবতীয় খরচ মিটাতে হবে । অসৎ উপায়ে উপার্জনের মাঝে অসহায় , মজলুম মানুষের অভিশাপ মিশ্রিত থাকে । ওই রকম অবৈধ টাকা দিয়ে কখনো মানসিক শান্তি পাওয়া যায় না।
    বস্তুতান্ত্রিক এই যুগে অভিভাবকেরা ও সন্তানদের বস্তুতান্ত্রিক বিষয়গুলো পড়ার জন্য উৎসাহিত করেন । যেসব বিষয় পড়লে কাড়ি কাড়ি অর্থ উপার্জনের পথ সুগম হয় । নৈতিকতা সমৃদ্ধ বিষয়গুলো পড়ার জন্য এখন কারোর আগ্রহ নেই । কি অভিভাবক বলেন , কি শিক্ষার্থী বলেন- সবাই এখন অর্থ উপার্জনের আলাদীনের চেরাগরুপী সোনার চাবি খুজেন । নৈতিকতা বিষয় ধুয়ে কি পানি খাব? চাকরির বাজারে কোন দাম নাই , এই সব নৈতিক বিষয়ের । এই ধরনের মন মানসিকতা সমাজে বিরাজমান ।
    ফলশ্রুতিতে কি হল ? অর্থ ঠিকই আসল , বাড়ি গাড়ি সব হল । অবকাঠামোগত পার্থিব সব সুযোগ সুবিধার দ্বার উন্মুক্ত হল। কিন্তু ,ছেলে আমার কথা শুনে না । মেয়ে আমার কথাকে পাত্তা দেয় না। ছ্বেলেকে ল্যাটেস্ট মডেলের মোবাইল কিনে না দিলে ঘরের আসবাব পত্র ভাংচুর করে । ছেলের পডার রুমে সিগারেটের গন্ধ, ড্রয়ারে পাওয়া যায় ইয়াবার পোটলা।
    মা বাবা বাসায় না থাকলে ছেলে তার বান্ধবীদের নিয়ে মাস্তি করে। মাস্তি বেশী করতে গিয়ে , মাত্রাতিরিক্ত টয় ব্যবহার করে আরেক জনের আদরের দুলালী কে চিরতরে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেয়।
    যার মনে স্রষ্টার ভয় আছে সে কখনো অন্যায় দূর্নীতি , জুলুম লুটপাট করতে পারে না । আল্লাহ তায়ালা সব অপরাধ মাফ করলে ও পরের হক মাফ করবেন না । অন্যায়ভাবে অপরের সম্পদ বিনষ্ট করলে , বা দখল করলে, আরেকজনের ন্যায্য অধিকার হরন করলে বা নিজস্ব স্বার্থ সিদ্ধির জন্য আটকে রাখলে , তা কখনো আল্লাহ তায়ালা মাফ করবেন না । এগুলো হল হাক্কুল ইবাদ তথা বান্দার হক । বান্দার হক আল্লাহ তায়ালা কখনো মাফ করেন না ।
    এসব বিষয় গুলো সন্তানদেরকে শিখাতে হবে। অথবা পরোক্ষভাবে কোরান হাদীস , ইসলামী সাহিত্য দিয়ে সুকৌশলে এসব বিষয় শিখানোর ব্যবস্থা করতে হবে । শুধু শিখালে বা উপদেশ দিলেই হবে না । এসব বিষয় আমার মাঝে তথা অভিভাবকের মাঝে আছে কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে । কথা কাজে মিল না থাকা মহান রবের নিকট অতি গর্হিত বিষয় ।
    কথায় আছে , সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে । আপনার সন্তান কার সাথে মিশতেছে , কোথায় সময় পার করছে এগুলো ও সতর্কতার সাথে নজরদারী করতে হবে । এটা খুবই কমন সিনারিও যে , স্কুল কলেজে , কোচিং এ যাওয়ার নাম করে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে বন্ধু – বান্ধবী নিয়ে অযাচিত সময় নষ্ট করে । যেখান থেকে বিভিন্ন অপরাধমুলক অঘটনের সুত্রপাত ঘটে ।
    এই ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্টান / কোচিং কতৃপক্ষের নৈতিক দায়িত্ব হল , নিয়মিত সূচী অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিয়ে অভিভাবককে রিপোর্ট করা । তাহলে , কর্মব্যস্ত অভিভাবক গন তাদের প্রাণপ্রিয় সন্তানদের গতিবিধি সম্পর্কে সহজেই ওয়াকিবহাল হতে পারবেন ।
    তাছাড়া , অনেক রাজনৈতিক দল গুলোর বড় বড় নেতারা তাদের নিজস্ব স্বার্থ সিদ্ধির জন্য শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে থাকেন । এলাকার বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক প্রভাব প্রদর্শনের মোহ তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখে । শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান্ সরকারি অফিস, হাসপাতাল , পুলিশি থানায় রাজনৈতিক প্রভাব প্রদর্শন করতে পেরে নিজেদের অনেক কিছু মনে করেন ।
    আবেগের বশে অনেকে তরুণ বেমালুম ভুলে যায় যে , দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় পুলিশ প্রশাসন যেভাবে তাদের সমীহ করেন , দল ক্ষমতাচ্যুত হলে তারা লাথির কাঠালে পরিনত হবে । তখন , বিভিন্ন অযুহাতে গ্রেপ্তার করে এই একই পুলিশ তাদেরকে অন্ধকার প্রকোষ্টে নিয়ে গিয়ে বেধডক পিটুনি দিয়ে আধা লাশ বানিয়ে ফেলে। তখন সবচেয়ে বেশী কষ্ট পান সন্তানের মা বাবা ।
    যারা বুয়েট ছাত্র আবরারকে পিটিয়ে মারল , তারা ও আমাদের সন্তান ,। তারা অতি মাত্রায় আবেগ প্রদর্শন করতে গিয়ে এই জঘন্য কর্মটি করল । আবরার যদি সত্যিই অপরাধ করে থাকে , তাহলে আইন আছে, বিচার ব্যবস্থা আছে , শাসন ব্যবস্থা আছে , । কিছু বিপদগামী তরুন অতি উৎসাহী হয়ে তাদের নেতাদের সন্তুষ্ট করতে তারা আবরারকে পিটিয়ে মারে । কোন মায়ের বুক খালি করলে , ঐ মা বাবাই জানেন সন্তান হারানোর বেদনা কত যন্ত্রনাময় ।
    প্রত্যেক সন্তান তাদের মা-বাবার কাছে অতি আদরের ধন । শত আশা আর স্বপ্ন নিয়ে মা বাবা বিভিন্ন প্রতিকুলতা আর কষ্ট সহ্য করে সন্তানদের বড় করেন । এই বুকের মানিক যখন হারিয়ে যায় কার ও গুলিতে–আঘাতে–প্রহারে , তখন ওই অসহায় মা বাবার ক্রন্দনে আকাশ, বাতাস এমনকি আরশ ও প্রকম্পিত হয় । এই মজলুম মা-বাবার অভিশাপ বর্ষিত হয় ঐ খুনীদের উপর । হাদীস শরীফের ভাষ্য অনুযায়ী, মজলুম , মুসাফির আর সন্তানের জন্য মা বাবার দোয়া আল্লাহ তায়ালা কখনো ফিরিয়ে দেন না । প্রিয় বৎস , মজলুমের অভিশাপ থেকে বেঁচে থাক ।
    রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এলাকায় বিভিন্ন কিশোর গ্যং বা গ্রুপিং এর উদ্ভব হয়েছে । ছোটখাট বিষয়ে মারপিট এমনকি , খুনাখুনির ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে এসব কিশোর গ্যং এর দ্বারা । প্রশাসন সৎ এবং আন্তরিক হলে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।
    পার্থিব ক্ষমতা কর্তৃত্ব এগুলো চিরদিন থাকে না। আল্লাহ যাকে চান দান করেন , আবার যখন ইচ্ছা কেডে নেন । সুতরাং , ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে দূর্বলের উপর অত্যাচার করা সমীচিন নয় । মা-বাবার হক , আত্বীয় স্বজনের হক , প্রতিবেশীর হক সর্বোপরি হাক্কুল ইবাদ সম্পর্কে তালিম দেওয়া প্রয়োজন ।
    এরপর ও যদি সন্তান বিপথে যায় , অনেক ক্ষেত্রে এরকম হয়ে থাকে , মা বাবার শত চেষ্টা থাকা সত্তে ও সন্তান নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায় , বিপথগামী হয়ে যায় । এই ক্ষেত্রে, মা-বাবার উচিত হবে সন্তানের জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করা। সন্তানের জন্য মা বাবার দোয়া বিফলে যায় না।
    মা বাবার প্রত্যেক সন্তান সুপথে চলুক , বিপথ গামী সন্তান সুপথে ফিরে আসুক সেই শুভ প্রত্যাশা রইল।