কেন বারবার সংঘর্ষ আল আকসায় 

    0
    12

    আল আকসা মসজিদ কেন ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘর্ষের হটস্পট হয়ে উঠেছে? এটি মুসলমানদের জন্য একটি পবিত্র স্থান। অন্যদিকে ইহুদিরা এটিকে সবচেয়ে পবিত্র স্থান ‘টেম্পল মাউন্ট’ মনে করেন। শুক্রবার থেকে জেরুজালেমের এই মসজিদকে ঘিরে সংঘর্ষে ১৭০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। রোববারও মসজিদ প্রাঙ্গণে ফের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এদিন আহত হয়েছেন ২০ জনেরও বেশি মানুষ। ফজরের নামাজের সময় মসজিদ কম্পাউন্ডে ইসরাইলি পুলিশের হানা ছিল বর্বরোচিত। তা-ও পবিত্র রমজান মাসে। এ ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম নয়, প্রায়ই আল আকসা মসজিদকে ঘিরে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। কেন এমনটি হচ্ছে? সে বিষয়েই বিস্তারিত ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে ফার্স্ট পোস্ট।

    আল আকসার তাৎপর্য : আল আকসা হলো ৩৫ একর জায়গার ওপর স্থাপিত একটি সীসা-গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদের নাম-যা মুসলমানদের কাছে আল হারাম আল শরিফ হিসাবে পরিচিত। এটি ইসলামের তৃতীয় পবিত্র স্থান। এর কম্পাউন্ডে রয়েছে ডোম অব দ্য রক (পাথরের আশ্রয়), চারটি মিনার, কম্পাউন্ডের ঐতিহাসিক গেট এবং সুবিশাল মসজিদ। ইহুদিরা এটিকে বলে টেম্পল মাউন্ট-ইহুদি ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র স্থান। মসজিদটি যে পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে-সেটি জেরুজালেমের ওল্ড সিটিতে অবস্থিত, এটি একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।

    ইহুদিরা যা বিশ্বাস করে : ইহুদিরা বিশ্বাস করে টেম্পল মাউন্ট-যেখানে দুটি প্রাচীন ইহুদি মন্দির ছিল। যার একটি নির্মাণ করেছিলেন রাজা সলোমন এবং সেটি ধ্বংস করেছিল ব্যবিলনীয়রা। আর দ্বিতীয় মন্দিরটি ধ্বংস করেছিল রোমানরা। যাই হোক, ইহুদি আইন এবং ইসরাইলি নিয়মানুযায়ী এই কম্পাউন্ডের ভেতরে প্রার্থনা করতে নিষেধ করা হয়। কারণ, তাদের ধারণা-এই পবিত্র স্থানটিকে পদদলিত করা অপমানজনক। তারা আরও বিশ্বাস করে, এই নিদর্শন থেকেই বিশ্ব সৃষ্টির গোড়াপত্তন হয় এবং ঈশ্বর এখানে তার পূর্ণ উপস্থিতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

    মুসলমানরা যা বিশ্বাস করে : আরবি ভাষায় আল আকসার দুটি অর্থ রয়েছে। প্রথমটি ‘সর্বাধিক দূরত্বে’-পবিত্র কুরআনের উল্লেখ অনুযায়ী যা মক্কা থেকে এর দূরত্বকে বোঝায়। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে ‘সর্বোচ্চ’-যা মুসলমানদের মধ্যে এর মর্যাদাকে চিহ্নিত করে। মুসলমানরাও বিশ্বাস করেন এই সেই স্থান, যেখানে সর্বশেষ নবি হযরত মুহাম্মদ (স.) মক্কা থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত এক অলৌকিক রাতের যাত্রার প্রার্থনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পবিত্র কুরআন অনুযায়ী নবিজিকে রাতের বেলায় মক্কার পবিত্র মসজিদ থেকে দূরতম মসজিদে (আল আকসায়) নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখান থেকেই এই বিশ্বাস তৈরি হয় যে, নবি মুহাম্মদ বেহেশতে আরোহণ করেছিলেন-যাকে বলা হয় শবেমেরাজ।

    দ্বন্দ্ব : ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ প্যালেস্টাইনকে তৎকালীন ব্রিটিশদের অধীনে দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছিল-একটি ইহুদিদের জন্য এবং একটি ফিলিস্তিনিদের জন্য। ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণার পর ১৯৪৮ সালে প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ হয়। আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সে সময় ইসরাইল প্রায় ৭৮ শতাংশ ভূমি দখল করে এবং পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজার অবশিষ্ট এলাকা মিসরীয় ও জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ইসরাইল পূর্ব জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করলে ১৯৬৭ সালে সিরিয়া, মিসর এবং জর্ডানের সঙ্গে ছয় দিনের একটি যুদ্ধ সংঘটতি হয়। আর তখনই জেরুজালেম এবং আল আকসা দখল করে ইসরাইলিরা। ১৯৮০ সালে ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে জেরুজালেমকে ইসরাইলের ‘পূর্ণাঙ্গ ও ঐক্যবদ্ধ’ রাজধানী হিসাবে একটি আইন পাশ করে। যদিও বিশ্বের কোনো দেশই জেরুজালেমের ওপর ইসরাইলের মালিকানা পরিবর্তনের প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দেয় না। জেরুজালেমের ফিলিস্তিনিরা সেখানে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও শুধু স্থায়ী বসবাসের মর্যাদা ধারণ করে, নাগরিকত্ব নয়। শহরে জন্মগ্রহণকারী ইহুদিদের ক্ষেত্রে এমন হয় না। বছরের পর বছর ধরেই এই বৈষম্যের শিকার হন ফিলিস্তিনিরা।

    অতীতের সংঘর্ষ ও বিবাদ : ১৯৬৯ সালের আগস্টে ডেনিস মাইকেল রোহান নামে একজন অস্ট্রেলিয়ান খ্রিষ্টান আল আকসাকে পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এবং জটিলভাবে খোদাই করা মিম্বারটি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। ১৯৯০ সালে ডোম অব দ্য রকের জায়গায় তৃতীয় মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের উদ্যোগ নিলে দাঙ্গা শুরু হয় এবং ইসরাইলি পুলিশের হামলায় ২০ ফিলিস্তিনি নিহত হন। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে ইসরাইলি রাজনীতিবিদ এরিয়েল শ্যারন প্রায় ১ হাজার পুলিশ সদস্য নিয়ে পবিত্র স্থানে প্রবেশ করেছিলেন। এ সময় ফিলিস্তিনিদের বিদ্রোহ শুরু হয় এবং ৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি এবং প্রায় এক হাজার ইসরাইলি নিহত হন। ২০১৪ সালে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ ১৯৬৭ সালের পর প্রথমবারের মতো আল আকসায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়।