গণিত ভীতি ও কিছু কথা মোহাম্মদ আবদুল বাতেন,

0
222

ইন্সট্রাক্টর ( কম্পিউটার সায়েন্স), পিটিআই, চট্টগ্রাম

শুরু করছি গণিতে একসময় পিছিয়ে পরা শিক্ষার্থী পরবর্তিতে গনিতের ভীতিকে জয় করার গল্প দিয়ে।

ড. লিবার্টি ভিটার্ট স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন “আমার বয়স যখন ১৪ বছর, তখন আমার গণিতের শিক্ষক বাবা-মাকে স্কুলে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন যে আমি গণিতে কাঁচা এবং আমার গণিত পড়ার কোন মানে নেই।”

সেই ভিটার্ট পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয় এমআইটি (ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি) থেকে গণিতের ওপর পিএইডি ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। শুধু তাই নয়, বর্তমানে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ও পরিসংখ্যান বিভাগে শিক্ষকতা করছেন তিনি।

এমন অজস্র উদাহরণ আমার বিশ্বাস অনেকেরই জানা আছে। তাছাড়া, এই গণিত ভীতির কারণে পড়াশোনাই ছেড়ে দিয়েছেন এমন উদাহরণ ও নিশ্চয়ই আশেপাশে কম জানা নেই, তাই নয় কি?

গণিতের প্রতি ভয়কে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ম্যাথম্যাটিকস এনজাইটি বা ম্যাথেফোবিয়া।

গণিতবিদ মেরি ডি লেলিস গফ ১৯৫৩ সালে ‘ম্যাথেফোবিয়া’ শব্দটি প্রথম প্রচলন করেন।

আমেরিকায় ২০১২ সালে সাত থেকে নয় বছর বয়সী শিশুদের মস্তিষ্কের স্ক্যানে দেখা গেছে যে যারা গণিত নিয়ে উদ্বিগ্ন তাদের মস্তিষ্কের অ্যামিগডালে নামের অংশটি কম সক্রিয় থাকে।

সাধারণত মানুষ কোন বিপদে পড়লে বা দুশ্চিন্তা করলে তা মোকাবিলায় মস্তিষ্কের অ্যামিগডালে অংশটি কাজ করে তাকে ওয়ার্কিং মেমোরি বা ক্ষণস্থায়ী স্মৃতিও বলা হয়। কম্পিউটারের সাথে তুলনা করলে যাকে বলা যায় র‍্যাম। কম্পিউটার যখন কোন কাজ করে তখন সেই র‍্যামে রেখে কাজটি প্রসেস করে থাকে। তাই, এক সাথে যখন অনেক কাজ প্রসেস হতে থাকে কম্পিউটার কিছু্টা সময়ের জন্য স্লো বা হ্যাং হয়ে থাকে।

আমরা যারা গণিত করতে গিয়ে উদ্বিগ্ন হই, তখন সেই উদ্বিগ্নতা ওয়ার্কিং মেমোরি দখল করে রাখে, ফলে গণিতের সমস্যা সমাধানের জন্য ওয়ার্কিং মেমোরি কাজ করতে পারে না।

তবে, জেনে অবাক হবেন যে ইউরোপের উন্নতদেশগুলো যেমন আমেরিকা, বৃটেন কে পিছনে ফেলে গণিত ও বিজ্ঞানে সেরা পাঁচের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে এশিয়ার দেশ যেমন সিঙ্গাপুর , হংকং, দক্ষিন কোরিয়া, জাপান এবং তাইওয়ান।

ইউরোপের সহযোগিতা এবং উন্নয়ন সংস্থা ওইসিডি-র শিক্ষা বিষয়ক পরিচালক এ্যান্ড্রেয়াস স্লাইশার মতে, এশিয়ার দেশগুলো অত্যন্ত দক্ষ শিক্ষকদের ক্লাসরুমে কাজ করতে উৎসাহিত করতে সক্ষম হয়েছে, যার ফলে সকল ছাত্র ভাল শিক্ষক পাচ্ছে। তারমানে, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকল্পে দক্ষ শিক্ষক একটি প্রাইম ফ্যাক্টর।

তবে, গণিতে এশিয়ার দেশগুলোর এই সফলতার পেছনে আরো কিছু ফ্যাক্টর ও রয়েছে। আসুন, একটু আলচনা করা যাক-

তার প্রথমটি হলো, সহজবোধ্য গাণিতিক ভাষা ও সংখ্যার নামকরণ পদ্ধতি। যেমন ইংরেজিতে, ১৩ থেকে বলা হয় থার্টিন, ফোর্টিন, ফিফটিন ইত্যাদি সেই ধারাবাহিকতায় কোন শিশু যদি তার আগের সংখ্যাগুলো কে বলে ১১ মানে ওয়ানটিন, ১২ মানে দুইটিন তা নিশ্চয়ই দোষের কিছু হবে না।

পক্ষান্তরে, আমাদের শিশুরা শিখে এক দশ এক, এক দশ দুই, এক দশ তিন ইত্যাদি। সংখ্যার নামকরণ পদ্ধতির এই সহজবোধ্যতার জন্যই এশিয়ার দেশগুলো অন্যদের তুলনায় এগিয়ে।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ন ফ্যাক্টর হচ্ছে, কায়িক পরিশ্রম। আমরা যদি ইউরোপের দেশগুলোর কথা চিন্তা করি দেখতে পাব, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বেশ লম্বা একটা সময়ে তাঁরা চলে যায় শীতনিদ্রায়।

কিন্তু, এশিয়ার দেশগুলো থাকে ধান উৎপাদনে কর্মব্যস্ত সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম , অসীম ধৈর্য্য শক্তি ও অনেক সাধনার পর কিভাবে সেই কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে তুলতে সেই বিষয়ে খুব দক্ষ। সাধারনত, ধান উৎপাদন অন্য সব ফসলের চেয়ে বেশি কষ্ট সাধ্য ও পরিশ্রমের তাই এই বিষয়টি এখানে অবতারণ করা হলো। তাছাড়া, এশিয়ার দেশগুলোর প্রধান অর্থকারি ফসল হচ্ছে ধান।

গণিত অলিম্পিয়াডের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তার মতে, যেসব দেশ ঐতিহ্যগতভাবেই পরিশ্রমী এবং ফলের চেয়ে চেষ্টা করাতেই সবচেয়ে বেশি মন দেয়, দিনশেষে স্বর্ণপদক জয়ে তারাই বেশি এগিয়ে থাকে।

তৃতীয় ফ্যাক্টরটি হলোঃ শিক্ষাবর্ষের স্বল্পতা, কয়েকটি দেশের শিক্ষাবর্ষ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আমেরিকাতে শিক্ষাবর্ষের ব্যপ্তি কেবলমাত্র ১৮০ দিন, দক্ষিণ কোরিয়ায় ২২০ দিন, এবং জাপানের সঙ্গে আমেরিকার ফারাকটা ৬০ দিনের।

আমেরিকার স্কুলগুলোতে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ চলে প্রায় আড়াই মাস ব্যাপী যেখানে জাপানে মাত্র প্রায় ছয় সপ্তাহ। সেই, তুলনায় বাংলাদেশে আরো ওনেক কম।

ফলে, এই স্বল্প সময়ে দীর্ঘ সিলেবাস শেষ করতে গিয়ে শিক্ষককে পাঠদান করতে হয় ঝড়ের গতিতে, যাকে বলা হয় ‘সিংক-অ্যান্ড-সুইম’ পদ্ধতি। কে বুঝলো, কে বুঝেনি সেদিকে খায়ল করার সুযোগ খুবই কম,ফলে যারা দুর্বল তারা ধীরে ধীরে দূর্বলতর হতে থাকে।

মূল আলোচ্য বিষয় হলো, গণিতে ভালো করার সবগুলো ফ্যাক্টরই বাংলাদেশের অনুকূলে আছে, যেমনটা আছে এশিয়ার সেরা দেশগুলোর ক্ষেত্রে।

এতোসব পজেটিভ ফ্যাক্টর থাকা সত্বেও এশিয়ার দেশগুলো গণিত শিখনে এগিয়ে গেলেও সামগ্রিক অর্থে আমাদের শিক্ষার্থীরা গণিতে পিছিয়ে। পিছিয়ে থাকার এই দায় কে নিবে? আমাদের কারিকুলাম নাকি পাঠদান পদ্ধতি নাকি দক্ষ শিক্ষককের অভাব!

প্রকৃতপক্ষে – গণিত শিখাতে হবে আনন্দের সাথে, ভয়হীন পরিবেশে, বাস্তবতার সাথে রিলেইট করে, জীবন ঘনিষ্ঠ করে,গণিত শেখার বেশ কিছু গেইম আছে সেগুলো খেলার ছলে, পর্যাপ্ত উপকরণ যেমন বাস্তব উপকরণ, পোস্টার পেপার, মাল্টিমিডিয়া উপকরণ সহ নানাবিধ পদ্ধতি, কৌশল ও কার্যক্রম এর সমন্বয়ে।

গণিত অলম্পিয়াড প্রোগ্রাম নিঃসন্দেহে গণিত শিখনের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। দেরীতে হলেও, আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে এর যাত্রা শুরু হয়েছে, যা আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে। এই প্রশিক্ষণে হাতে-কলমে শেখানো হয়, কিভাবে আনন্দের সাথে, ভয়হীন পরিবেশে হাতে তৈরী স্বল্প মূল্যের মজার সব উপকরনের মাধ্যমে খেলার ছলে মনের অজান্তেই গণিত শেখানো যায়।

আমাদের মনে রাখতে হবে, আনন্দের সাথে যে শিখন, অভিজ্ঞতামূলক যে শিখন, বাস্তবধর্মী যে শিখন, সেই শিখনই হচ্ছে দীর্ঘস্থাই