জেলা পরিষদ নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন

    0
    14

    প্রভাব বিস্তারে মাঠে এমপিরা

    আসন্ন জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটার না হলেও প্রভাব বিস্তারে মাঠে তৎপর স্থানীয় সংসদ-সদস্যরা। ভোটাররা স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন ধাপের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। এদের অনেকেই দলীয় নেতা হওয়ায় নানাভাবে তাদের সবার ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও করছেন তারা।

    পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিতে নানা ধরনের চাপ দেওয়ার অভিযোগও উঠছে। করছেন নানা ধরনের সভা-সমাবেশ। এতে আচরণবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে। এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ দাখিলের ঘটনাও ঘটেছে। একই সঙ্গে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও উঠেছে। ১৭ অক্টোবর জেলা পরিষদ নির্বাচন।

    স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন-ভোটে এমপিরা প্রভাব বিস্তার করলে নির্বাচন আরও বিতর্কিত হবে। নির্বাচন কমিশন বলছে-নির্বাচনি পরিবেশ সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত রাখতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন তারা। কোনো জেলায় যাতে স্থানীয় এমপি-মন্ত্রী বা প্রভাবশালী কেউ ভোটে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে সে বিষয়ে কঠোর দৃষ্টি রাখছেন।

    এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে স্থানীয় এমপি সাহেবরা প্রভাব বিস্তার করেন। এ নির্বাচনেও এটা হচ্ছে। নির্বাচনে ভোটাররা একাধিক প্রার্থীর মধ্যে থেকে সুন্দর পরিবেশে অবাধ-সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত ভোটে স্বাধীনভাবে তাদের পছন্দের প্রার্থী বেছে নেবেন। এখানে একদিকে নির্বাচন প্রভাবিত করার অপচেষ্টা হচ্ছে। আবার ইতোমধ্যে ২২ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন। যেখানে বিকল্প থাকে না এবং বিকল্প থাকলেও যদি প্রভাব বিস্তার করা হয়, তাহলে সেটা তো নির্বাচন হয় না। সেটা হবে প্রহসন। নির্বাচন অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে হবে এবং এমপিদের প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

    জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটার স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। সিলেক্টিভ ভোটার হওয়ায় প্রার্থীরা তাদের নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। তবে এই নির্বাচনে বেশি প্রভাব বিস্তার করছেন স্থানীয় সংসদ-সদস্যরা। বেশ কয়েকটি জেলায় ইতোমধ্যে স্থানীয় এমপিরা তাদের পছন্দের প্রার্থীদের পক্ষে মাঠে নেমেছেন।

    কিছু কিছু জেলায় ভোটারদের (স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি) নিয়ে সভাও করেছেন তারা। প্রকাশ্যে বা অভ্যন্তরীণ সভা-সমাবেশে পছন্দের প্রার্থীদের জন্য ভোটও চাচ্ছেন তারা। নিজের পছন্দের বাইরের অন্য প্রার্থীদেরও দিচ্ছেন নানা ধরনের চাপ। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় এই জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানরাই পদে থাকবেন। এদের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি এবং ভোটারদের নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই সংসদ-সদস্যরা পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে মাঠে তৎপর।

    যদিও বিদ্যমান আইনে বলা আছে, জেলা পরিষদ নির্বাচনে জাতীয় সংসদের কোনো এমপি-মন্ত্রী নিজ এলাকায় গিয়ে কোনো প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনি প্রচার বা নির্বাচনি কাজে অংশ নিতে পারবেন না। শুধু নির্বাচনি কাজে অংশগ্রহণই নয়, তাদের ব্যবহৃত কোনো সরকারি যানবাহন বা অন্য কোনো বস্তুও প্রার্থীর কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না।

    জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, যেহেতু স্থানীয় এমপিরা জেলা পরিষদের ভোটার নন এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সেহেতু উনাদের নির্বাচনি এলাকায় অবস্থান না করাই ভালো।

    ২০১৬ সালে গেজেট আকারে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে [এসআরও নং ৩৪১-আইন/২০১৬, জেলা পরিষদ আইন-২০০০ (২০০০ সনের ১৯নং আইন) এর ধারা ২০ (২)] বলা হয়েছে- সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীর নির্বাচনি প্রচারণা এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা বাধানিষেধ: ১. ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী নির্বাচনপূর্ব সময়ে নির্বাচনি এলাকায় প্রচারণায় বা নির্বাচনি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করিতে পারিবেন না।

    তবে শর্ত থাকে যে, উক্ত রূপ ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকার ভোটার হইলে তিনি শুধু তাহার ভোট প্রদানের জন্য ভোটকেন্দ্রে যাইতে পারিবেন।’ ২. ‘নির্বাচন পূর্ব সময়ে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা তাহার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান নির্বাচনি কাজে সরকারি প্রচারযন্ত্র, সরকারি যানবাহন, অন্য কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ এবং সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীগণকে ব্যবহার করিতে পারিবেন না।’

    এখানে সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলতে প্রজ্ঞাপনের ১ নম্বর ধারার ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি অর্থ প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সরকারের মন্ত্রী, চিফ হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদ উপনেতা, বিরোধীদলীয় উপনেতা, প্রতিমন্ত্রী, হুইপ, উপমন্ত্রী বা তাহাদের সমমর্যাদার কোনো ব্যক্তি, সংসদ-সদস্য এবং সিটি করপোরেশনের মেয়র।

    তবে আচরণ বিধিতে নিষেধ থাকলেও অনেক জেলাতেই তা মানা হচ্ছে না। আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর আগেই এ নিয়ে ইসির কাছে অভিযোগও জমা পড়তে শুরু করেছে। নীলফামারীর এক সংসদ-সদস্যের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছেন জেলা পরিষদ নির্বাচনের চেয়ারম্যান প্রার্থী (স্বতন্ত্র) বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন।

    ১৩ সেপ্টেম্বর রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন জেলা পরিষদের এ সাবেক চেয়ারম্যান। এছাড়া সংবাদ সম্মেলন করেও অভিযোগ জানিয়েছেন এই প্রার্থী। এছাড়া ঢাকা বিভাগের এক জেলায় স্থানীয় সংসদ-সদস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার অভিযোগও উঠেছে। অন্য জেলায় আওয়ামী লীগের এক সংসদ-সদস্যের বিরুদ্ধে ভোটারদের ওপর চাপ প্রয়োগের অভিযোগ রয়েছে।

    এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের এক নেতা যুগান্তরকে বলেন, স্থানীয় এমপিদের প্রতি সপ্তাহে নির্বাচনি এলাকায় নানা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হয়। ফলে তারা অবশ্যই এলাকায় অবস্থান করতে পারেন, তবে কোনোভাবেই নির্বাচনি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। আবার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা এমপিদের অবস্থান নিয়ে আপত্তি করলেও তাদের নির্বাচনি এলাকা ত্যাগ করতে হবে। কারণ এমপিরা এলাকায় থাকলে বিভিন্নভাবে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা থেকে যায়। আমরা (আওয়ামী লীগ) চাই নির্বাচন বিতর্কমুক্ত হোক। এ বিষয়ে আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই নির্দেশনা দেবেন।

    ১৭ অক্টোবর ভোটের দিন চূড়ান্ত করে ৬১ জেলা পরিষদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করেছিল নির্বাচন কমিশন। তবে ১৯ জেলায় একজন করে প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। এছাড়া যাচাই-বাছাইয়ে আরও তিন জেলার একজন ছাড়া অন্যদের প্রার্থিতা বাতিল হয়। ফলে ২২ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। বাকি ৩৯ জেলার পরিষদে চেয়ারম্যান পদে মোট বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা ১৪২ জন।

    সাধারণ সদস্য পদে এক হাজার ৭৪১ জন ও সংরক্ষিত সদস্য পদে ৬৭৩ জন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বৈধ হয়েছে। ২৫ সেপ্টেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় শেষ হবে। এরপর রিটার্নিং কর্মকর্তারা একক প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করবেন। বাকি জেলাগুলোতে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। ২৬ সেপ্টেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর শুরু আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা।