যেসব কারণে সৌদি-কাতার আবারো এক হলো

0
50

উপসাগরীয় সংকট সমাধানে কাতারের সঙ্গে আকাশ, ভূমি এবং জলসীমা পুনরায় খুলে দেয়ার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রস্তাবে সোমবার সম্মত হয় সৌদি আরব।উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) বার্ষিক সম্মেলনে মঙ্গলবার সৌদি আরব পৌঁছালে কাতারি আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সঙ্গে কোলাকুলি করেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান।উষ্ণ অভ্যর্থনা কাতারের সঙ্গে তার উপসাগরীয় প্রতিবেশীদের দীর্ঘদিন ধরে চলমান সংকট সমাধানের ইঙ্গিত দেয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, চির প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানকে মোকাবিলায় আঞ্চলিক জোট গঠনের লক্ষ্যেই নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করছে উপসাগরীয় দেশগুলো।আনাদোলু এজেন্সিকে ইয়েমেনি রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুতাহার আল সোফারি বলেন, পুনর্মিলনের চুক্তিকে উপসাগরীয় সংকটের আংশিক সমাধান বলা যেতে পারে।তিনি বলেন, ইরানের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক অবরোধ বাস্তবায়ন করছে যুক্তরাষ্ট্র। উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোও চাচ্ছে তেহরানের ওপর আরো চাপ তৈরি করতে, নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়ন এবং নিজেদের সহায়তায় নিজেরাই এগিয়ে আসতে।সৌদি আরবের ঐতিহাসিক শহর আল উলায় জিসিসি সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ইরানের হুমকি মোকাবিলার আহ্বান জানান সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান।তেলসমৃদ্ধ দেশটির এ শাসক বলেন, ইরানের পরমাণু, ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কার্যক্রম, বিধ্বংসী এবং ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিৎ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।জিসিসি সম্মেলন, সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একীভূত করবে, নিজেদের মধ্যে পুনর্মিলন এবং সংহতি জোরদার করবে বলে বিশ্বাস বিন সালমানের।তিনি বলেন, অঞ্চলকে এগিয়ে নেয়া, পারিপার্শ্বিক চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে ইরানের পরমাণু হুমকি মোকাবিলার জন্য জিসিসি রাষ্ট্রগুলোর নিজেদের শক্তির একীভূতকরণ অত্যন্ত জরুরি।সম্মেলনে সংকট সমাধানের জন্য একটি চুক্তিতে সই করেছেন উপসাগরীয় দেশগুলোর নেতারা। তবে চুক্তির বিস্তারিত তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।

ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক:
সম্মেলনের আগে কুয়েতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমাদ নাসের আল সাবাহ সৌদি এবং কাতারের মধ্যে আকাশ, ভূমি এবং জলসীমা পুনরায় উন্মুক্তকরণের ঘোষণা দেন।আল সোফারি বলেন, উপসাগরীয় দেশগুলোর পুনর্মিলনের অনেক কারণ থাকতে পারে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে কুয়েত অব্যাহতভাবে কাজ করছে। দীর্ঘদিন ধরে কাতারের বিরুদ্ধে চাপ তৈরি করা হলেও দোহার অবস্থানে কোনো পরিবর্তন হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের চাপও ছিল দেশটির উপর, বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড  ট্রাম্প চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। এছাড়া, তিনিও চেয়েছেন হোয়াইট হাউস ছাড়ার আগে ইরানকে মোকাবিলায় উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যাতে ঐক্যবদ্ধ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়।ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে উত্তেজনা কমানোর উপায়টি প্রাথমিক পদক্ষেপ বলে জানান আল সোফারি।তিনি বলেন, উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির পেছনে সৌদি আরবের নিজস্ব কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। রিয়াদ ব্যাপকভাবে চাচ্ছে আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করতে। যাতে দ্রুত সৌদি আরবের বাদশাহ হিসেবে বিন সালমান আত্মপ্রকাশ করতে পারেন। অর্থাৎ তার বাদশাহ হওয়ার পথ যেন সুগম হয়। জিসিসি সম্মেলনে বিন সালমানের সভাপতিত্ব করাও তার একটি প্রমাণ।সেপ্টেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকের চুক্তি করে। পরে সুদান এবং মরক্কো তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে।

অর্থনৈতিক ক্ষতিসমূহ:
বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং ঝুঁকি, যেসবের মাধ্যমে পুরো অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বাস্তবিক অর্থে সে কারণগুলো উপসাগরীয় দেশগুলোকে একত্রিত হতে উদ্বুদ্ধ করেছে বলে আনাদোলু এজেন্সিকে জানান কাতারি রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাবের আল হারামি।আল হারামি বলেন, আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ, ইয়েমেন, ইরাক, সিরিয়ায় ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের চ্যালেঞ্জ এবং রিয়াদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা; সবগুলো কারণ একসাথে হয়ে সংকট এবং মতানৈক্য দূর করার জন্য রাজনৈতিক একটি সদিচ্ছা তৈরি করেছে।জ্বালানি মূল্য নির্ধারণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের কারণে গেল তিন বছরের বেশি সময় ধরে রিয়াদ এবং দোহা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, গেল বছর এর সঙ্গে যুক্ত হয় করোনা মহামারী।আল হারামি বলেন, গেল সাড়ে তিন বছরে সবপক্ষই সংকটের কারণে চড়া মূল্য দিয়েছে। উভয়ে বুঝতে পেরেছে সংকট দীর্ঘায়িত করলে জিসিসিসহ পুরো অঞ্চলেরই মারাত্মক ক্ষতি। এ কারণে সংশ্লিষ্টরা সংকট সমাধানের বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছেন।উপসাগরীয় অচলাবস্থার কারণে জিসিসি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর উপর জোটের যে প্রভাব ছিল তাও ব্যাপকভাবে খর্ব হয়।বাইডেনের জয়:
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ সামরিক ঘাঁটি কাতারে। ট্রাম্প প্রশাসন উদ্বিগ্ন ছিল, ওয়াশিংটনের আঞ্চলিক মিত্রদের মধ্যে যদি ফাটল থাকে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিয়ে ইরান বিরোধী শক্তিশালী জোট গঠন করতে পারবে না।রাজনৈতিক বিশ্লষক আল হারামি বিশ্বাস করেন, সংকট সমাধানের জন্য উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর উপর ব্যাপক চাপ তৈরি করেছিল ট্রাম্প প্রশাসন। যাতে ২০ জানুয়ারি নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে ট্রাম্প প্রশাসন কূটনৈতিক আরেকটি বিজয় ঘোষণা করতে পারে।আল হারামি বলেন, কুয়েতের মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তাপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সংকট সমাধানে যা সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। সংকটের শুরু থেকে কুয়েত মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া শুরু করে। প্রয়াত শেখ সাবাহ আল আহমাদ এ প্রক্রিয়া শুরু করেন। পরে কুয়েতের বর্তমান আমির শেখ নায়েফ আল আহমাদ একই পথে এগিয়ে যান।টেলিভিশনে প্রচার হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, জিসিসি সম্মেলনে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন ট্রাম্পের মেয়ে জামাই এবং তার জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জ্যারাড কুশনার সম্মেলনের একটি কক্ষে বসে আছেন।২০১৭ সালের ৫ জুন ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, সন্ত্রাসবাদে সহায়তার অভিযোগে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিশর  এবং কাতারের উপর অবরোধ আরোপ করে।কাতার বরাবরই এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছে। বলেছে, সম্পর্কে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়ার মতো বৈধ কোনো কারণ নেই। প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে সার্বভৌমত্বে আক্রমণের অভিযোগও তোলে কাতার।সূত্র: আনাদোলু এজেন্সি।