জমি বন্ধক রেখে হাদিসুরকে পড়াশোনা করিয়েছিল পরিবার

    0
    24

    ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে আটকে পড়া বাংলাদেশি জাহাজের নাবিক হাদিসুর রহমান মারা গেছেন। বাংলাদেশ সময় গত বুধবার রাত ১১টায় এই খবর জানতে পারে তার পরিবার।

    ওই দিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে ‘বাংলার সমৃদ্ধি’তে রকেট হামলা হয়। এতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান হাদিসুর। প্রথমে গণমাধ্যম মারফত এই খবর জানতে পারে তার পরিবার। পরে জাহাজে থাকা সহকর্মীরাও ফোন করে তা জানান।

    কান্নাজড়িত কণ্ঠে মর্মান্তিক এই মৃত্যু নিয়ে কথা বলেন হাদিসুরের ছোট ভাই তরিকুল ইসলাম তারেক। তিনি বলেন, ‘অন্য নাবিকেরা বলছেন, আমার ভাইয়ের লাশ জাহাজের ফ্রিজে রাখছেন তারা। আমার মা জানি লাশটা একবার দেখতে পান। এটাই শুধু আমরা চাই এখন।’ 

    পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন হাদিসুর
    সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনে ২০১৪ সালে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন বরগুনার বেতাগীর হোসনাবাদ গ্রামের ছেলে হাদিসুর। বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন তিনি। বর্তমানে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন।

    তরিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, জমি বন্ধক রেখে বড় ছেলেকে পড়াশোনা করিয়েছিলেন তার বাবা। সাত বছরে বন্ধকী জমির অনেকটাই ছাড়িয়েছিলেন হাদিসুর। কিন্তু শেষ করতে পারেননি সেই কাজ।

    তিনি বলেন, ‘ভাইয়া আব্বা-আম্মাকে বলতো, অনেক কষ্ট করেছো তোমরা। এখন খালি সুখ করবা। কিন্তু সেই সুখ হলো না। তারও হলো না। আমার বাপ-মায়েরও হলো না।’
    অবসরপ্রাপ্ত মাদ্রাসা শিক্ষক বাবা আব্দুর রাজ্জাক আর অসুস্থ মা আমেনা বেগমের চার সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন হাদিসুর। এক বোনের পরে তিনজন ভাই। ভাইদের মধ্যে বড় ছিলেন তিনি।

    ‘এবার ফিরে বিয়ে করার কথা ছিল’
    গত আড়াই মাস ধরে সাগরেই ছিলেন হাদিসুর। সম্প্রতি পরিবারকে তিনি জানিয়েছিলেন, তার বেতন বেড়েছে। তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভাইয়া বলছিল, এবার বাড়িতে এসে নতুন ঘর তুলবে। তারপর বিয়ে করবে বলছিল আমাদের। অসুস্থ মায়ের খাওয়া-দাওয়া নিয়ে ছিলেন খুব চিন্তিত। এজন্য মা কী খাচ্ছেন, কখন আর কতটুকু খাচ্ছেন নিয়মিত সে খবর নিতেন তিনি।’

    বুধবার সকালেও ছোট ভাই আর মায়ের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে সে খবর নিয়েছিলেন হাদিসুর। অসুস্থ মাকে নিয়ে পটুয়াখালী ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলেন তরিকুল ইসলাম। সকালেই বাড়ি ফিরেছেন।

    তিনি বলেন, ‘পটুয়াখালী থেকে সকালে ফিরতেছি যখন, সেই সময় ভাইয়া আমার আর মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। মার খাওয়ার খোঁজ নিসে, আর তারে বলছে, তোমার পছন্দমতো বাজার করে বাড়ি যেও।’

    স্নাতক চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তরিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আর কিচ্ছু চাই না। খালি ভাইয়ের লাশ চাই। তার কবর দেখতে চাই। আমার মা জানি লাশটা একবার দেখতে পায়। এটাই আমাদের চাওয়া এখন।’

    তরিকুল ইসলামের দাবি, বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের নাবিকদের কাছে এসব কথা জানিয়েছেন তারা।

    বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে রকেট হামলা নিয়ে আজ (বৃহস্পতিবার) ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেছেন, নিহত হাদিসুরের মরদেহ জাহাজের ভেতরেই ফ্রিজে রাখা হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা লাশ আনার চেষ্টা করবো। তবে কবে লাশ আনা সম্ভব হবে সেটা বলা মুশকিল।’

    বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের নির্বাহী পরিচালক পীযুষ দত্ত চট্টগ্রামে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এই মুহূর্তে জাহাজটি বন্দর ছেড়ে যাওয়া নিরাপদ নয়। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সবাইকে জাহাজে অবস্থান করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

    জাহাজটিতে এখনও নাবিক এবং ইঞ্জিনিয়ারসহ ২৮ জন অবস্থান করছেন। গত ২৬ জানুয়ারি এটি ভারতের মুম্বাই বন্দর থেকে যাত্রা করে এবং তুরস্কের ইরেগলি হয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরের বহির্নোঙ্গরে পৌঁছায় বাংলার সমৃদ্ধি।
    জাহাজটি বন্দরে পৌঁছানোর পরদিন ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরু হয়। দত্ত জানিয়েছেন, জাহাজটিতে এক মাসের খাদ্য মজুত রয়েছে।

    দুই দিন আগে আটকে পড়া জাহাজের একজন নাবিক সাক্ষাৎকারে দেশে ফিরে আসার জন্য তাদের তীব্র আকুতির কথা জানিয়েছিলেন। বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজটির মালিক বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন।