যুদ্ধ এবার বাংলা ভাষার পঠন দক্ষতা বৃদ্ধি করার!

    0
    20

    মোহাম্মদ আবদুল বাতেন

    ইন্সট্রাক্টর( কম্পিউটার সায়েন্স)

    পিটিআই, চট্টগ্রাম ।

    ১৯৫২ সালে যে বাংলা ভাষার জন্য লড়াই করে শহীদ হয়েছেন সালাম , বরকত, রফিক, যাদের রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি মাতৃভাষা বাংলা কে, সেই ভাষার জন্য আবার সময় এসেছে যুদ্ধ করার। তবে এবারে সংগ্রাম কারো বিরুদ্ধে নয়, অস্ত্র, গোলাবারুদ কিংবা কামান নিয়ে নয়। এবারের সংগ্রাম আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার সুনাম রক্ষার, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাতৃভাষার পঠন দক্ষতা সমৃদ্ধ করার। এবার আসুন আলোচনা করি, মাতৃভাষা বাংলায় আমাদের শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতা, কেন যুদ্ধ করার দরকার এবং কীভাবে আমরা জয়ী হতে পারি।

    আমি এই প্রচেষ্টাকে যুদ্ধের সাথেই তুলনা করলাম, কেননা এটা বর্তমানে একটা জাতীয় ইস্যু, যা প্রকট আকার ধারণ করেছে এবং যেভাবেই হউক এই প্রচেষ্টায় আমাদের জয়ী হতেই হবে।

    প্রতিবছর বাংলাদেশে ৯৮ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হলেও শতকরা ৬৫ জন শিক্ষার্থীই ঠিকঠাক বাংলা পড়তে পারে না। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক একটি জরিপে উদ্বেগজনক এ তথ্য উঠে এসেছে।

    জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারেনা। ইংরেজি ও গণিতে দুর্বলতা তার চাইতেও বেশি। তাছাড়া, প্রাথমিক শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ সকলের ও একই অভিযোগ শিক্ষার্থীরা বাংলা রিডিং পড়তে পারে না এবং সেই সংখ্যাটা খুবই আশঙ্কাজনক।
    মাতৃভাষার দক্ষতা শিশুদের মননশীলতা,বুদ্ধিভিত্তিক ও যুক্তিশীলতার বিকাশে সহায়তা করে। তাই , বাংলা ভাষার দক্ষতা অর্জনে শোনা, বলা, পড়া ও লেখা এই চারটি দক্ষতার প্রতি জোড় দেওয়া হয়েছে। শোনা ও বলার দক্ষতা একজন শিশু জন্মের পর পরিবার থেকে, পরিবেশ থেকে মনের অজান্তে ধীরে ধীরে অর্জন করতে থাকে।
    সবচেয়ে বেশি প্রকট যে সমস্যা, সেটা হল সাবলীল ভাবে পড়তে না পারা। মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্বেও ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে না পারা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার চরম দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে বৈকি ।
    কবি আবদুল হাকিম এর বঙ্গবাণী কবিতায় বলেছেন-
    “ যেই দেশে যে বাক্য কহে নরগণ
    সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন।“
    অথচ, আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যেনো চলছে উল্টো দিকে।

    আমরা জানি, বাংলাদেশের শিক্ষাক্রম হচ্ছে যোগ্যতাভিত্তিক। প্রতিটি বিষয়ের জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা বিষয়ভিত্তিক প্রান্তিক যোগ্যতা। তেমনি, বাংলা বিষয়ে মোট ১৪টি প্রান্তিক যোগ্যতার মধ্যে ৩টি সরাসরি পড়ার সাথে সম্পর্কিত।তারমধ্যে, শুদ্ধ, স্পষ্ট ও প্রমিত উচ্চারণে পড়তে পারবে একটি অন্যতম যোগ্যতা।

    তাছাড়া, বিশ্বব্যাংক পৃথিবীর নিম্ন আয়ের দেশগুলোর শিক্ষা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দারিদ্র্যের বিভিন্ন সূচকের সঙ্গে শিক্ষা-দারিদ্র্য নামে একটি সূচক যুক্ত করেছে। শিক্ষা–দারিদ্র্যের মাপকাঠি ধরা হয়েছে ১০ বছর বয়সে বা প্রাথমিক শিক্ষার সমাপ্তিতে কত শতাংশ মাতৃভাষায় (অথবা দেশের প্রধান ব্যবহারিক ভাষায়) নির্ধারিত পড়া ও লেখার দক্ষতা আয়ত্ত করতে পারে।

    অ্যামনেস্টিনি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ-পূরেরব এশিয়া ও প্যাসিফিক বিষয়ক পরিচালক নিকোলাস বেকুইলিন এর মতে, “ আপনি যখন কন নতুন ভাষা বা নতুন কিছু শিখতে যাবে তখন প্রথমে তা মনে মনে নিজের মাতৃভাষায় তর্জমা করে নেবেন। এতে আপনার বোঝার বা শেখার প্রক্রিয়াটি অনেক বেশি সহজ ও কার্যকর হবে।

    বিশ্বব্যাংকের হিসাবে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোয় অর্ধেকের বেশি (৫৬ শতাংশ) ছেলেমেয়ে এই দক্ষতা অর্জন করে না। বাংলাদেশের এই হার ৫৩ ।

    কারন, বাংলা ভাষা সাবলীলভাবে পড়তে না পারলে, শিশু পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে না,অন্য বিষয়গুলোতে ও ভাল করতে পারে না।কারন, যেকোন বিষয় সঠিক ও সাবলীল্ভাবে পড়তে না পারলে সে বিষয়ের মূলভাব বুঝা যায় না, ফলে শিশুদের কাছে অস্পষ্টতা থেকে যায়।
    ফলে, তারা ক্রমে পিছিয়ে পড়ে, শিশুদের বড় এক অংশ তখন ঝরে পড়ে। যারা টিকে থাকে, তারাও তখন আসলে কিছু শেখা বা বোঝার পরিবর্তে তোতাপাখির মতো মুখস্থের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যায় ।

    তাইতো ব্রাজিলের বিশ্বখ্যাত শিক্ষাবিদ পাওলো ফ্রেইরে-র মতে, “ সাক্ষরতা শুধু শব্দ (ওয়ার্ড) পাঠ নয়, বরং বিশ্বকে (ওয়ার্ল্ড) পাঠ” ।

    ইউনেস্কোর সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম। শিক্ষার্থীদের অনুপাতে প্রয়োজনীয় দক্ষ শিক্ষকের অভাব। আবার যে কজন আছেন তারাও তাদের পুরো সময় পাঠদানে দিতে পারেন না। কারন, তাদের পাঠদান ছাড়া ও আরো নানাবিধ কাজ যেমন, শিশু জরিপ, জনশুমারি, ভোটার হালনাগাদ, টয়লেট গণনা ইত্যাদি সহ আর অনেক কাজে সম্পৃক্ত থাকতে হয়, ফলে আসল কাজেই মনোনিবেশ করার সুযোগ থাকেনা।

    বর্তমানে, ইংরেজী ভাষার দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বহু টাকা খরচ করে ব্রিটিশ কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে ১৮ সপ্তাহ ব্যাপী প্রশিক্ষণ চলমান আছে, নিঃসন্দেহে এটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কিন্তু, মাতৃভাষায় দক্ষতা উন্নয়নের বিষয়ে আমাদের সকলের উদাসীনতা মোটেও কাম্য নয়।
    তাই, এখনি সময় এই বিষয়ে সবাইকে মনোনিবেশ করতে হবে, না হয় প্রাথমিক শিক্ষার এই দুরাবস্থা থেকে আমরা বের হতে পারব না, ফলে জাতি অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

    সাহিত্যের পাঠ গতানুগতিক অন্য বিষয়ের পাঠদানের মতো নয়, এখানে বেশ কিছু পদ্ধতি, টেকনিক ও কার্যক্রম থাকে, যেগুলো ফলো করলে বেশ ফলপ্রসূ পাঠদান সম্ভব। তাই, এখনি আমাদের সংশ্লিষ্ট সবাইকে এই বিষয়ে নজর দিতে হবে।

    রিডিং দক্ষতা অর্জনের জন্য ৫টি সুনির্দিষ্ট মৌলিক দক্ষতা রয়েছে যেমন বর্ণ সচেতনতা , ধ্বনি সচেতনতা, শব্ধ ভান্ডার, সাবলীলতা ও বোধগম্যতা এই বিষয়েগুলতে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এই পাঁচটি মৌলিক দক্ষতা অর্জন করাতে পারলে শিশুদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে, আর বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলেই পঠন দক্ষতা অর্জন করানো সম্ভব।

    প্রয়োজনে, এই বিষয়ে শিক্ষদের দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য স্পেশাল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এখনো যারা প্রশিক্ষণের আওতায় আসেনি দ্রুত তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।এবং সবচেয়ে জরুরী যেটা, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ চালু করা। সর্